চট্টগ্রামে গাড়ি থামায় পুলিশ, তল্লাশি চালায় অন্যরা

চেক পোস্টে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালাবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখের বিভিন্ন পয়েন্টের চেক পোস্টে গাড়ি থামায় পুলিশ, আর তল্লাশি চালায় মাদক চোরাকারবারীরা।

পুলিশের সংকেতে চেক পোস্টে গাড়ি থামানের পর তাতে তল্লাশি শুরু হয়। গাড়িতে অবৈধ কিছু পাওয়া না গেলে চা খরচের নামে চালকের কাছ থেকে আদায় করা হয় টাকা।

গত মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টা। চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেট চেক পোস্ট। ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাস এগিয়ে আসছে। বাসটিকে থামার সংকেত দেন চেক পোস্টে থাকা দুই পুলিশ সদস্য। বাস থামানোর সঙ্গে সঙ্গে মালবক্সে তল্লাশিতে নেমে পড়েন সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি। গাড়ির ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালান আরও দুইজন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি। গাড়ির মালবক্স ও যাত্রীদের তল্লাশি শেষে অবৈধ কিছুই পাননি তারা।

এরই মধ্যে ‘চা খাওয়ার জন্য’ গাড়ি থেকে নামতে চালককে ডাক দেন এসআই জাকের। চেক পোস্টের পাশেই একটি টং দোকানে লম্বা বেঞ্চ নিয়ে আগে থেকে বসে ছিলেন তিনি। চালক কাছে আসতেই সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি ‘চা খরচ’ দাবি করে বসেন। ২০০ টাকা থেকে দরকষাকষি করে ১০০ টাকা দিয়ে প্রায় ২০ মিনিট পর গাড়ি ছাড়ার অনুমতি পান ওই চালক।

এভাবেই চট্টগ্রাম নগরীর প্রবেশ পথ সিটি গেট তোরণে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ অবস্থান নিয়ে এসব অনিয়ম ও চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছে চেক পোস্টের পুলিশ সদস্যরা। এ ধরনের স্থায়ী চেক পোস্ট রয়েছে নগরীর কর্ণফুলী সেতু এলাকায়, অক্সিজেন মোড় ও কালুরঘাটে। এ ছাড়া ‘সারপ্রাইজ চেক পোস্ট’ নাম দিয়ে নগরজুড়ে শতাধিক চেক পোস্টও বসিয়েছে পুলিশ।
গোপনে মোবাইল ফোনে তোলা সিটি গেট চেক পোস্টের নানা অনিয়মের স্থিরচিত্র বুধবার সকালে দেখানো হয় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্যকে। এরপর তিনি চেক পোস্টে অনিয়মের বিষয়ে সতর্ক করে ওসিদের এসএমএস পাঠান। এই প্রসঙ্গে দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘চেক পোস্টে কোনো অবস্থায় পাবলিক অংশ নিতে পারে না। এই ঘটনা আমরা তদন্ত করে দেখবো। এই বিষয়ে আমি ওসিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলবো। চেক পোস্টগুলো যেখানে স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। ক্যামেরার আওতাভুক্ত এলাকায় যাতে তল্লাশি চালানো হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।’

চেক পোস্টে পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে কারা তল্লাশি চালাচ্ছে- তা অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর প্রবেশমুখ আকবর শাহ থানার সিটি গেট এলাকায় স্থায়ী পুলিশ চেক পোস্টে পুলিশের সঙ্গে যানবাহন তল্লাশিতে অংশ নেয় চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারী ও অপরাধীরা। পুলিশের সংকেতে গাড়ি থামানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা তল্লাশিতে নেমে পড়েন। এরপর চেক পোস্টে ধরাপড়া মাদক কম মূল্যে কিনে নেন তারা। এই মাদক ব্যবসায়ী চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- টেকনাফের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর ও হাফিজ, ফকিরহাটের শরীফ, মোশাররফ, আলাউদ্দিন, সেলিম, ইদ্রিস। এরা সবাই সিটি গেট পুলিশ চেক পোস্টে জব্দ হওয়া মাদক কিনে নিয়ে যায় এবং চেক পোস্টে পুলিশের সঙ্গে তল্লাশিতে অংশ নেয়।

শুধু তাই নয়, নিজেদের মাদক যাতে নির্বিঘ্নে শহরে ঢুকে যেতে পারে, সেজন্যও কেউ কেউ চেক পোস্টে অবস্থান নেন। চেক পোস্টে মাদক ব্যবসায়ী সেলিমের উপস্থিতিতে তার মামাতো ভাই দাউদকান্দি থেকে মাদক নিয়ে নগরীতে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া নিউ শহীদ লেইন এলাকার বাসিন্দা মনির ওরফে বাইট্টা মনিরও চেক পোস্টে উদ্ধার হওয়া মাদক কেনেন। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় সবার বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চেক পোস্টে মাদক ধরা পড়ার পরও হচ্ছে না মামলা-জব্দ তালিকা। টাকার বিনিময়ে মাদক বাহককে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি উদ্ধারকৃত মাদক বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ২৭ জানুয়ারি গভীর রাতে নগরীর সিটি গেট এলাকায় ১৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ নারী-পুরুষকে আটক করে আকবর শাহ থানার এসআই ও এএসআই। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি। এ ছাড়া জব্দ তালিকা না করে ইয়াবাগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে মোবাইল ডিউটির সময় ১৫০ বোতল ফেনসিডিল আটক করে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন আকবর শাহ থানার এক এসআই। এর আগে সিটি গেট চেক পোস্টে ৭০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করলেও তা জব্দ তালিকায় দেখাননি একই থানার আরেক এসআই।

চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুর সড়কের বাস চালক মো. কামাল বলেন, সিটিগেটে পুলিশ সিগন্যাল দিলে তারা থামেন। চেক করে অবৈধ কিছু না পেলে ছেড়ে দেবেন- এটাই নিয়ম। কিন্তু তারা বলে কাগজপত্র দেখাও। কাগজে সমস্যা না পেলে আবার বলে চায়ের পয়সা দাও। আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টা আটকে রাখে। আবার ভালো অফিসারও আছেন, তারা অবৈধ কিছু না পেলে চলে যেতে বলেন। চট্টগ্রামে ঢুকার পথে গাড়ি বেশি ধরে। মাছ অবৈধ না। মাছ পেলে তারা ঝামেলা করে। ১০০/২০০ টাকা দিতে হয়। পুলিশের সঙ্গে থাকা দালালরা এ টাকা নেয়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার আব্দুল জলিল মণ্ডল বলেন, চেক পোস্টে সাদা পোশাকে অংশ নিতে দেখেছেন, কালকে থেকে এসব আর দেখবেন না। এখনই তিনি নির্দেশনা দিচ্ছেন। চেক পোস্টে অনিয়মের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন, কঠোর পদক্ষেপ নেবেন। এ ছাড়া সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার মধ্যে যাতে চেক পোস্টের কার্যক্রম চলে, সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই