চরম অসহায় শিক্ষাব্যবস্থা

সাফাত জামিল শুভ : “চাবুকের ভয় দেখিয়ে হয়তো বনের বাঘকেও চেয়ারে বসানো শিখিয়ে ফেলা যাবে,কিন্তু আমরা একে ওয়েল ট্রেইন্ড বলতে পারি,ওয়েল এডুকেটেড নয়” – আলোড়ন সৃষ্টিকারী মুভি “থ্রি ইডিয়টস” এর অন্যতম একটি সংলাপ এটি, যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবিকে ইঙ্গিত করে। এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি ও অসঙ্গতি দূর করতে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সরকারের সময় নানাধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে সারাবিশ্ব যখন তুমুল বেগে এগিয়ে চলছে, তখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন গতানুগতিকতার বৃত্তেই বন্দী।

শিক্ষা ব্যবস্থার চরম অসঙ্গতি’র কারণে দিনের পর দিন জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা বিপর্যস্ত করছে সামাজিক অবস্থান। বাস্তবমুখী শিক্ষার অভাবে চলমান সময়ে আমাদের জাতীয় উপলব্ধি অনেকটাই অনুপস্থিত, যার ফলশ্রুতিতে মানুষ দিনের পর দিন হয়ে উঠছে আত্নকেন্দ্রীক ও স্বার্থবিভোর। এদেশের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিয়ত সঙ্কীর্ণ স্রোতধারায় প্রবাহিত হওয়ায় মনের অজান্তেই মানুষ বিভাজিত ও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

আমাদের দেশের বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যবইগুলো মোটেই ‘সুখপাঠ্য’ নয়। পড়াশোনা করে জ্ঞান আহরণের যে আনন্দ, বর্তমান প্রজন্ম তা বুঝতেই পারেনা। গতানুগতিক ধারায় লিখিত পাঠ্যবইগুলো কোন আকর্ষণই করতে পারেনা তাদের। পরীক্ষাভীতি বা বাবা-মায়ের প্রচন্ড চাপে তারা শুধু মুখস্থই করে যায়, মনস্থ করতে পারেনা কখনো। পাঠ্যবই যেন তাদের নিকট একপ্রকার বোঝাস্বরূপ।

আমাদের চরম দুর্ভাগ্য -পাঠ্যবই লেখার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এদেশের জাতীয় মেধাবীদের আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আজ যদি গুণী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ এর সাবলীল ভাষায় লেখা পাঠ্যবই পড়ানো হত? আজ যদি পলিমার ক্যামেস্ট্রিতে পিএইচডি প্রাপ্ত প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদকে ‘রসায়ন’ বই রচনার দায়িত্ব দেয়া হত? পদার্থবিজ্ঞান বা তথ্য-প্রযুক্তির বইগুলো রচনার দায়িত্ব যদি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দেয়া হতো? আত্নবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, শিক্ষার্থী হুমড়ি খেয়ে পড়াশোনা না করলেও অন্তত পাঠ্যবইকে অবজ্ঞা করতনা।

গভীর উদ্বেগের পরিলক্ষিত হয়, এদেশে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষাকে কেন্দ্র করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একপ্রকার হিংসাত্নক মনোভাব জন্ম নেয়। পরীক্ষায় নম্বরের প্রতিযোগিতা শিখিয়ে তাদের মধ্যে আমরা হিংসা সৃষ্টি করি।সেসময় থেকেই তারা আত্নকেন্দ্রীক ও স্বার্থবিভোর হতে থাকে।এভাবে মনের অজান্তেই আমরা দিনের পর দিন হিংসুক এবং স্বার্থপর প্রজন্ম সৃষ্টি করছি। স্বাভাবিকভাবেই তারা ভবিষ্যতে দেশ কিংবা মানুষ কোন কিছু নিয়েই ভাববে না। ভাববে শুধুই নিজের কথা। কারন সেই শিক্ষাই তো ছোট থেকে তারা পেয়েছে।

পৃথিবীর বহু দেশ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশে শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে চাহিদানুযায়ী আত্মকর্মসংস্থানমূলক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, যা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এ পর্যন্ত সেধরণের লক্ষণীয় কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কর্মস্পৃহা থাকা সত্ত্বেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুযোগের অভাবে অবসর সময়গুলো কাজে লাগাতে পারছেনা। এদের একটা বিরাট অংশ হতাশার দরুণ মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়তই। আধুনিকতার চাহিদায় চাকচিক্যের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আদর্শের সকল স্তর। বড় বড় আকাশচুম্বী অবকাঠামো’র ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ। সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে পারিবারিক বন্ধনও ভেঙে পড়ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে সচেতন করছে পারছেনা, ফলে লোভ-লালসা ও বিবেকহীন লুটপাটের মাধ্যমে উচ্চ শ্রেণি শুধু শোষণ করেই যাচ্ছে।

অন্যদিকে এদেশে পর্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে প্রতি বছরই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ যথাযথ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার দরুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টারের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে।

প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রনহীন অপব্যবহার ও অপ-সংস্কৃতির করাল গ্রাসে এদেশের শিক্ষা,শিল্প-সংস্কৃতি ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে সন্তানের। এখনি সচেতন না হলে তরুন প্রজন্ম একসময় জনদায়ে পরিণত হবে।
সার্বিক মানোন্নয়ন ও তাদেরকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে কর্মমুখী তথা বাস্তবমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই।

এ প্রজন্মকে একতরফা দোষারোপ না করে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সজাগ থাকতে হবে।কেননা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে গতানুগতিকতা ও ত্রুটি পরিহার করে বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠন করতে।

সাফাত জামিল শুভ
শিক্ষার্থী,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই