চার শিশুহত্যা : সন্দেহভাজন আরেক যুবক আটক

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের তালুকদার পঞ্চায়েতের চার শিশুহত্যায় জড়িত সন্দেহে সালেহ আহমেদ (২৪) নামে আরেক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। সালেহ সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাসিন্দা।

শনিবার সকালে তাকে বাহুবল মডেল থানা পুলিশ ওই গ্রাম থেকে আটক করে হবিগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

এর সত্যতা নিশ্চিত করে বাহুবল মডেল থানার ওসি মোশারফ হোসেন জানান, ইতিপূর্বে উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বশির মিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আদালতে তার ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। এদিকে বশিরের ভাই সালেহ আহমদকে লোকজনের সন্দেহ হচ্ছে। এ কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।

এদিকে চার শিশুহত্যার দায় স্বীকার করেছে আসামি আবদুল আলী বাগালের ছেলে ফয়জাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী রুবেল মিয়া। ১৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ কৌশিক আহমেদ খোন্দকারের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিকালে সে এই দায় স্বীকার করে।

রুবেলের জবানবন্দি দেওয়া শেষ হওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পর হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র তার সভাকক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, সুন্দ্রাটিকি গ্রামে বাঘাল পঞ্চায়েত এবং তালুকদার পঞ্চায়েতের বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এক মাস আগে উভয় পঞ্চায়েতের সীমানায় থাকা একটি বরই গাছ কাটা নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। পরে বিষয়টি সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করা হলেও সিএনজি চালক বাচ্চু মিয়া ও গ্রেফতারকৃত আরজু ভীষণভাবে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়। এর পর থেকেই তারা পরিকল্পনা করে তালুকদার পঞ্চায়েতের শিশুদের হত্যা করবে।

১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে পূর্ব ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে যায় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই আবদাল মিয়ার ছেলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭), আরেক চাচাতো ভাই আবদুল আজিজের ছেলে ফয়জাবাদ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও পাশের বাড়ির আবদুল কাদিরের ছেলে, সুন্দ্রাটিকি আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসার নুরানী প্রথম শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল মিয়া (১০)।

বৃষ্টির জন্য খেলা না হওয়ায় শিশুরা হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। এ সময় ওত পেতে থাকা বাচ্চু মিয়া তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে সিএনজি অটোরিকশাতে উঠতে বলে। বাচ্চু মিয়া তাদের পরিচিত হওয়ায় সরল বিশ্বাসে চার শিশু অটোরিকশায় ওঠে। এ সময় তাদের চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে বাচ্চু মিয়ার গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরজু ও রুবেলসহ ছয়জন মিলে তাদের বুকের ওপর বসে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।

চেতনানাশকে নিস্তেজ হয়ে পড়া শিশুদের যে যেভাবে পারে সেভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। হত্যার পর লাশগুলো বস্তায় ভরে গ্যারেজেই লুকিয়ে রাখা হয়। গভীর রাতে গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইছারবিল খালের পাশে লাশগুলো বালিমাটিতে পুঁতে রাখা হয়। তবে পুলিশ ঘাতক দলের দুজনের নাম প্রকাশ করলেও তদন্তের স্বার্থে বাকি চার আসামির নাম প্রকাশ করেনি। তবে অপর একটি সূত্র জানায়, বেলাল মিয়া, শাহেদ, উস্তার ও বাচ্চু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।

পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র আরো জানান, ঘটনার আলামত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে বাচ্চুর ব্যবহৃত সিএনজি অটোরিকশা, আরজুর বাড়ি থেকে কোদাল আর শাবল, কয়েকটি বস্তা এবং একটি রক্তমাখা পাঞ্জারি উদ্ধার করা হয়েছে।

এসপি বলেন, রুবেলের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উন্মোচিত হয়েছে। তবে একজনের স্বীকারোক্তিই শেষ কথা নয়। সে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। আবার শত্রুতার কারণে কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করতে পারে। তাই তার স্বীকারোক্তিই শেষ কথা নয়। তদন্ত অব্যাহত থাকবে। আগামী ১৫ দিনের মাঝে তদন্ত সম্পন্ন করে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে। প্রাথমিক তদন্তে ছয়জনের নাম এলেও রুবেল এবং আরজু গ্রেফতার হয়েছে। অন্যরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। আরজুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমান মনিরসহ ডিবির ওসি এবং পুলিশ সদস্যরা।

পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ফান্ডের প্রায় ২০ লাখ টাকা পঞ্চায়েত সর্দার সেলিম আহমেদের কাছে জমা ছিল। এর মধ্যে গ্রামবাসীর যৌথ শিরনী অনুষ্ঠানে ৬ লাখ টাকা খরচ করা হয়। বাকি ১৪ লাখ টাকা সেলিম আহমেদের কাছে রয়ে যায়। সেলিম আহমেদের কাছে গিয়ে আবদুল আলী বাঘাল টাকার হিসাবনিকাশ চান। এ নিয়ে সেলিম আহমেদের সঙ্গে আবদুল আলীর কথা-কাটাকাটি হয় এবং তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেলিম আহমেদকে শায়েস্তা করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ তালুকদার পঞ্চায়েতের ওয়াহিদ মিয়া গংদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সিএনজি চালক বাচ্চু মিয়াকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাচ্চু মিয়া খুনিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চার শিশুকে তার সিএনজিতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে বাচ্চু মিয়ার সহযোগিতায় ঠান্ডা মাথায় নিষ্পাপ চার শিশুকে খুন করে ঘাতকরা। পরে সেলিম আহমেদের বালুর স্তূপে তাদের লাশ পুঁতে রাখে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বালু চাপা দেওয়ায় চার জনের মধ্যে একজনের হাত বালু থেকে বের হয়ে থাকে। তারা খুন হওয়ার পাঁচ দিন পর উল্লেখিত স্থান দিয়ে একই গ্রামের কাজল মিয়া অন্যদের সঙ্গে মাটি কাটার কাজে গেলে পচা গন্ধ পায়। পরে এ গন্ধের রহস্য খুঁজতে গিয়ে হাত দেখতে পায়। তারপর চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে।



মন্তব্য চালু নেই