চিনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ

এই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকা চিনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আফ্রিকা হলো বিশ্বের প্রথম দেশ যারা সবধরণের মিষ্টিজাতীয় পানীয়জাত পণ্যের ওপর করারোপ করার পরিকল্পনা করেছে। আর এই খবর আফ্রিকার সেসকল অধিবাসীদের আহত করেছে যারা তাদের প্রিয়জনকে নিয়ে কোন সুপারমার্কেটে ঘুরতে গেলে ঠান্ডা পানীয় ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করতে পারে না।

জোহানেসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়বর্ষের একজন ছাত্র বলেছেন, ‘মিষ্টি পানীয় ছাড়া আমরা আমাদের একটি দিনও কল্পনা করতে পারি না। তিনি আরো বলেন, আমরা মিষ্টি ঠান্ডা পানীয় পছন্দ করি কারণ আমাদের কাছে এটাকে বেশ সুস্বাদু লাগে’। আবার অনেকের কাছে মনে হয় মিষ্টি পানীয় ফ্রিজে থাকলে তা চটজলদি বাসায় অতিথি আসলে খুব সহজে পরিবেশন করা যায়। আর একজন বলেন, ‘আমি মিষ্টি ফান্টা খেতে পছন্দ করি আর তার ওপর করারোপ করে আমাকে এটা খাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না। যখন এর মূল্য বৃদ্ধি করা হবে আমরা এটা তখনো খাবো। সরকার যদি তার দেশের জনগণকে এটা খাওয়া থেকে বিরত রাখতে চায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই এটা সম্পূর্ণরূপে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে’।

দেশটিতে ৩৩০ মিলিলিটার একটি মিষ্টি পানীয়র বোতল কিনতে সর্বোচ্চ খরচ হয় মাত্র ০.৫০ ইউএস ডলার। আর এটা জনসাধারণের হাতের নাগালের মধ্যেই পড়ে। তাদের সাপ্তাহিক খাদ্যের তালিকায় এসব পানীয় পান করা প্রায় অপরিহার্য ব্যাপার। আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় সমস্যা। সম্প্রতি দেশটির অর্থমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতে বাজেট বক্তব্যে নতুন এই কর সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেন। কিন্তু কি কারণে অর্থমন্ত্রীর এমন সিদ্বান্ত তা সবাইকে একটু অবাক করেছে।

বলা হয়ে থাকে, দক্ষিণ আফ্রিকা পৃথিবীর সবচাইতে বেশি স্থূলকায় দেশ। দেশটিতে দিন দিন স্থূলতার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আর এর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে দেশটির জনসাধারণের মাঝে অতিরিক্ত মাত্রায় মিষ্টিজাতীয় পানীয় সেবনের প্রবনতা। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি চারজন মানুষের মধ্য একজন স্থুলতার সমস্যায় ভোগে। ২০১৩ সালে জোহানেসবার্গের হিউম্যান সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের একটি জরিপে বলা হয়, দেশে স্থুলতার সমস্যা বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হিসেবে চিনিই দায়ি।

সম্প্রতি অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার গড়ে ২৫ হাজার মানুষ প্রতিদিন ১৭ টেবিল চামচ চিনি বা চিনিজাতীয় পণ্য গ্রহন করে থাকে। আর এর ফলে দেশটির বেশিরভাগ জনসাধারণ দুধরণের রোগে খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। একটি হচ্ছে ডায়বেটিক এবং অপরটি কার্ডিওভাস্কুলার বা হৃদযন্ত্রের সমস্যা। যার ফলে মৃত্যুর সম্মুখিন হচ্ছেন অনেকেই। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও খারাপ অবস্থায় আছে মেক্সিকো। সেখানে একজন প্রতিদিন ৩৫ চামচ চিনি ব্যবহার করে থাকেন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিন একজন ব্যবহার করে ৪০ চামচ চিনি। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিদিন একজন ব্যাক্তিকে ১০ চামচ চিনি ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

এদিকে এই কর আরোপের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বেভারেজ অ্যাসোসিয়েশন কিছুটা ক্ষুদ্ধ। তারা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে যে, কেন সরকার প্রক্রিয়াজাত মিষ্টি খাবারের ওপর কর আরোপ না করে কেবলমাত্র মিষ্টি পানীয়র ওপর কর আরোপ করবে। তারা আরো বলেন, স্থুলকায় সমস্যার জন্য সরকার কেবল একটি মাত্র পণ্যকে কখনো দোষারোপ করতে পারে না। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কর কর্মকর্তা বলেন, মিষ্টি পানীয়র ওপর কর আরোপের এই পরিকল্পনাটি আমরা মেক্সিকোকে দেখে করেছি। মেক্সিকোতে স্থুলকায় সমস্যা রোধ করার জন্য চিনির ওপর চওড়া হারে কর আরোপ করা হয়েছিল।

কিন্তু যে সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে তা সত্যিই কি কোন কাজে আসবে এমন প্রশ্ন দেশটির জনসাধারণের। আর এ বিষয় নিয়ে এখনও চলছে নানা তর্ক বিতর্ক। অনেকে মনে করেন পানীয়র ওপর এই কর আরোপ করলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। তারা যেখানে ভালো খাবারই কিনে খেতে পারে না সেখানে এই সব পণ্য তাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু কর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই এই পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

তবে নীতি নির্ধারকরা বলছেন, ২০১৭ সালের এপ্রিলে এই কর বাস্তবায়নের আগে মিষ্টি পানীয়র বিকল্প হিসেবে কোন কিছু তৈরি করতে হবে। এছাড়া যদি এসব পণ্য বিক্রি কমে যায় তাহলে চিনি খাতেও এর দারুণ প্রভাব পড়বে। তাই সবদিক বিচার বিবেচনা করে মিষ্টিজাতীয় পানীয়র ওপর নতুন এই কর আরোপ করতে বলছে বিশেষজ্ঞরা।



মন্তব্য চালু নেই