চুমু বড়ই সুস্বাদু : তসলিমা

এবার চুমু নিয়ে মেতেছেন তসলিমা নাসরিন। ভারতে শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের চুমোচুমির আন্দোলনে মুগ্ধ তসলিমা! তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গে শতভাগ একাত্ম হয়েছেন। এতদিনে তিনি খুঁজে পেয়েছেন আনন্দে ভাসার কাক্সিক্ষত পথটি।

এই নিয়ে প্রতিদিন তার সমর্থন ও ভালবাসার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো লিখছেনই, এবার বিশাল নিবন্ধ তৈরি করেছেন চুমুর স্বাধীনতার পক্ষে। যে লেখায় বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার পূর্ণ আবেগের। চুমু নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি ছাড়েন শীর্ষেন্দুর মত বড়মাপের লেখককেও। তার ওপরও একহাত নিয়েছেন তিনি।

একটি অনলাইন মিডিয়ায় ‘চুমু চুমু চুমু’ শিরোনামে লেখা এ নিবন্ধটি our news bd পাঠকদের জন্য এখানে তুলে দেওয়া হল :

তসলিমা নাসরিন লেখেন ‘চুমুর মতো চমৎকার জিনিস আর হয় না। দিন দুপুরে চুমু খাব, প্রকাশ্যে খাব, একশ লোককে দেখিয়ে খাব । ‘আমার চুমু আমি খাবো, যেথায় খুশি সেথায় খাবো’ আন্দোলন চলছে এখন ভারতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা স্লোগান দিচ্ছে ‘চুমু চুমু চুমু চাই, চুমু খেয়ে বাঁচতে চাই’, ‘আমার শরীর আমার মন, দূর হঠো রাজশাসন’। কেরালার রাস্তায় চুমু খেয়েছিল বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তরুণ তরুণীকে, মিনিস্কার্ট পরেছিল বলে কলকাতার স্টার থিয়েটারে এক মেয়েকে ঢুকতে দিল না। মূলত নীতিপুলিশির প্রতিবাদেই ছেলেমেয়েরা চুমু খাচ্ছে। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে রাজ্যে রাজ্যে। রাস্তায়-নদীর পাড়ে-লেকের ধারে-পার্কে তরুণ তরুণীদের ঘনিষ্ঠ হতে দেখলেই নাকি পুলিশ এসে ঝামেলা করে। প্রেম করা যেন অন্যায়। জনসমক্ষে হাত ধরে হাঁটা, আলিঙ্গণ করা, চুমু খাওয়া এসব নাকি অশ্লীল। যৌনতাও নাকি অশ্লীল! ভায়োলেন্স কি অশ্লীল? আমার মনে হয় না কেউ সিরিয়াসলি বিশ্বাস করে ভায়োলেন্স অশ্লীল।
মনে আছে বীটল্সের জন লেনন কী করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ করেছিলেন? সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পুরো জগতকে দেখিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন: যৌন সঙ্গম করো, যুদ্ধ করো না। হিংসে আর ঘৃণার রাজনীতিতে যারা বিশ্বাস করে, তারা যৌন সঙ্গমের চেয়ে যুদ্ধকেই পছন্দ করে বেশি।

রাস্তা ঘাটে মানুষকে অসম্মান করো, অকথ্য ভাষায় গালি দাও, যৌন হেনস্থা কর, মারো, গরিব পকেটমারকে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলো, কোনও দৃশ্যই কারো কাছে খুব একটা অশ্লীল ঠেকে না। রাস্তায় মানুষ পানের পিক ফেলছে, কাশি ফেলছে, মলমুত্র ত্যাগ করছে, এসবে কেউ আপত্তি করছে না। মানুষ না খেতে পেয়ে, চিকিৎসার অভাবে মরে পরে আছে রাস্তায়- সেসব দৃশ্য কারও কাছে আপত্তিকর নয়। কিন্তু আপত্তিকর দৃশ্য যখন তুমি ভালোবেসে কারো হাত স্পর্শ করছো, ভালোবেসে কারো ঠোঁটে চুমু খাচ্ছো। ভালবাসাটা অপরাধ। ভালোবাসাটা অপরাধ বলেই চারদিকে আজ ঘৃণার জয়জয়কার।

অবাক লাগে ভাবতে যে বাংলার লেখক সাহিত্যিকরা এই একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্বাস করেন চুমুটা বাইরে খাওয়া উচিত নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন ‘এটা কোনো প্রতিবাদ এর ভাষা হতে পারে না। কুরুচির পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কেরালায় চুম্বন করে প্রতিবাদ হয়েছে বলে কলকাতায় করতে হবে তার মানে নেই’। পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, ‘নিজেদের অভিভাবকের ক্ষেত্রে ওরা এসব মানবে তো?’ নীতি পুলিশ সর্বত্র। এমনকী বুদ্ধিজীবি মহলেও।
প্রথম যখন ইউরোপে গেছি, অবাক হয়ে দেখেছি প্রায় বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ নারীপুরুষকে সমুদ্রের ধারে শুয়ে সূর্যস্নান করতে, শরীর যে সুন্দর, শরীর যে অশ্লীল নয়, তা সম্ভবত তখনই আমি আবিস্কার করি। যখন দেখি দুজন মানুষ গভীর চুম্বনে মগ্ন, বুঝি যে চুমুর জন্য চারদেওয়ালের প্রয়োজন নেই। চুমু খোলা আকাশের নিচেও বড় সুন্দর, বড় সুস্বাদু।

আমি তো মাঝে মাঝেই বলি, যৌনসঙ্গম কেবল চারদেওয়ালের বন্ধ ঘরে হতে হবে কেন! প্রকৃতির কাছে যাও, নির্জন বনে চলে যাও, নীরব সৈকতে চলে যাও পূর্ণিমার রাতগুলোয়, ভালোবেসে চুমু খাও, শরীরে শরীর মেলাও। আমরা তো প্রকৃতির সন্তান। জগত দেখুক, আমরা ভালবাসছি। আকাশ দেখুক, জুঁই ফুল দেখুক। আমার পাশ্চাত্যের বন্ধুরা এসবে অভ্যস্ত হলেও প্রাচ্যের বন্ধুরা নয়। তাদের কাছে এখনও শরীর- বিশেষ করে মেয়েদের শরীর অশ্লীল, এখনও যৌনতা অশ্লীল।

চুমুর স্বাদ ঘরে বাইরে আসলে একই। তবে ইচ্ছে হচ্ছে চুমু খেতে, লোকে কী বলবে বলে চুমু খেতে পারছি না, এই অবদমনের কষ্ট বড়সাংঘাতিক। আমার জীবনে প্রেমিক খুব বেশি কেউ ছিল না। তবে প্যারিস শহরে বাগানে, রাস্তায়, গাড়িতে, সিনেমায়, ক্যাফেতে যখন খুশি চুমু খেয়েছি আমার এক প্রেমিককে। গালে গালে শুকনো চুমুর কথা বলছি না। বলছি ঠোঁটের জিভের মুখগহবরের গভীর দীর্ঘ চুম্বনের কথা। চুমু ছাড়া জীবনকে আমার খুব শুকনো শুকনো লাগতো।
খুব ভালো লাগে যখন দেখি মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে। হিংসুকরা সহ্য করতে পারে না অন্যের ভালোবাসা। হিংসুকেরা মানুষে মানুষে ঘৃণা দেখে আরাম বোধ করে।

যারা প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার বিরোধী, এবং যারা পক্ষপাতী, লক্ষ করেছি, দু’পক্ষই পুরুষতন্ত্রকে দোষ দিচ্ছে। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া মানে নারীকে পণ্য করা, এ পুরুষতন্ত্রের কারসাজি। আবার প্রকাশ্যে চুমু খেতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য নারীকে ঘরবন্দী রাখা, নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়া, এও পুরুষতন্ত্রের কারসাজি। আমি পুরুষতন্ত্রের আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি নিতান্তই শরীরের পক্ষে যাচ্ছি। প্রেমের পক্ষে যাচ্ছি। নারী পুরুষের প্রেম, বা নারী নারীর প্রেম, বা পুরুষ পুরুষের প্রেম, সব প্রেমকেই আমি মেনে নিয়ে, সব প্রেমের প্রকাশকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি রাস্তা ঘাটে দেখতে চাই না কেউ মরে পড়ে আছে, কেউ ধুকছে, কেউ মার খাচ্ছে, কেউ মারছে কাউকে, অপমান করছে, জ্বালাচ্ছে, হেনস্থা করছে, ধর্ষণ করছে। আমি দেখতে চাই মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে। মানুষ মানুষকে চুমু খাচ্ছে। এমনকী আমি দেখলে খুশি হবো যে মানুষ ভালোবেসে যৌন সঙ্গম করছে। যৌন সঙ্গম যুদ্ধের চেয়ে দুর্ভিক্ষের চেয়ে মৃত্যুর চেয়ে দৃশ্য হিসেবে অনেক সুন্দর, অনেক পবিত্র।’

এভাবেই নিবন্ধটিতে চুমুর সপক্ষে মত রাখতে গিয়ে চুমু আন্দোলনকে ছাড়িয়ে সঙ্গমের সপক্ষে বলে হয়ত বা ফের নতুন কোন বিতর্কের ঢোলই বাজালেন তসলিমা নাসরিন।



মন্তব্য চালু নেই