ছাত্রলীগ: বয়সে ফিটফাট, অন্য কিছুতে সদরঘাট

ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২৫-২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৯ বছর বয়সোর্ধ্ব ছাত্রনেতারা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতে পারবেন না। ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে বয়সের এ নিয়মটি বর্তমানে গুরুত্ব সহকারেই পালন করা হয়।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, ছাত্রলীগ কেবল বয়সের নিয়মেই অনুগত। অন্যান্য সবকিছুতে নিয়ম মানার যেন কিছু নেই। কোনো কোনো ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়ম ভেঙে চাকরি পাওয়া, এমনকি ফৌজদারি মামলাও রয়েছে, যা সংগঠনটির গঠনতন্ত্র ও আদর্শের পরিপন্থী।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ২৭ থাকার কথা থাকলেও ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিলে ছাত্রলীগের ২৬তম সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ বয়সসীমা বাড়িয়ে ২৯ বছর করেন।

এদিকে নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ই ‘যোগ্য’ ছাত্রনেতারা এ দুটি পদের (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) দৌড়ে আটকে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি সম্মেলনেও বয়সের ফিতায় আটকে যাওয়ায় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার শীর্ষপদ পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বয়সসীমা ২৯ মানা হলেও নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে সংগঠনটি। এমনকি ২৯ বছরের বয়সসীমার বিষয়টি এখনো সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের পূর্বনির্ধারিত ২৭ বছরের স্থলে উল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকাল সম্পর্কে গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল ২ বৎসর। উপরিউক্ত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে।’

‘বিশেষ বা জরুরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল তিন মাস বৃদ্ধি করা যাবে। উক্ত সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ যোগ দেবেন।’

সম্মেলনের বিষয়ে গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ নির্দিষ্ট এক বৎসর কালের মধ্যে অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক বর্ধিত তিন মাস সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সম্মেলন করতে ব্যর্থ হলে, নির্বাহী সংসদের নিকট হতে সময়মতো দায়িত্ব ও সম্পদ বুঝে নেয়া নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য।’

‘দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য নির্বাচিত (জেলা সম্মেলন কর্তৃক) কাউন্সিলরদের সভা ডেকে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচন করে তাদের হাতে দায়িত্ব অপর্ণ করতে বাধ্য হবে। নতুবা উক্ত সময়ের পর নির্বাচন কমিশন আপনা-আপনি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।’

‘এহেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য মোট কাউন্সিলরের এক-চতুর্থাংশের উপস্থিতিতে নতুন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ গঠন করার ক্ষমতা ছাত্রলীগের নিয়মিত সদস্যগণ রাখেন।’

কিন্তু ২৬তম সম্মেলনে নির্বাচিত মাহমুদ হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের দুই বছর মেয়াদী কমিটি পরবর্তী সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ৫ বছর ৩ মাস পর।

২০১১ সালের ১০ ও ১১ জুলাই অনুষ্ঠিত ২৭তম সম্মেলনে বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার ৪ বছর ১৪ দিন পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৮তম সম্মেলন।

অনিয়মিত সম্মেলনের কারণে সাইফুজ্জামান শিখর, মারুফা আক্তার পপি, সাজ্জাদ সাকিব বাদশার মতো নেতারা অতীতে পদপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একই কারণে আসন্ন সম্মেলনেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের লড়াই থেকে ছিটকে পড়তে পারেন আলোচনায় থাকা অনেক নেতা। নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে এ সব নেতার শীর্ষপদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল বলে দাবি সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। এমনকি কেবল শক্তিশালী প্রার্থীদের বঞ্চিত করতেই সম্মেলনের সময় পেছানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পদের জন্য ২৯ বছরের বয়সসীমা অনুসরণ করা হলেও কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য অনেক পদেই ২৯ বছরের বেশি বয়সীরা পদায়িত হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা, রেজাউল করিম রেসিন, সাইফুদ্দিন সাইফ, রেজাউল করিম রাসেল (বর্তমানে গাজীপুরের কালিয়কৈর উপজেলার চেয়ারম্যান), যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, প্রচার সম্পাদক শাহরুক মিরাজ, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান আনিস পদায়িত হওয়ার সময় তাদের বয়স ২৯ বছরের ঊর্ধ্বে ছিল।

নাম না প্রকাশের শর্তে শীর্ষপদ প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা বলেন, ‘কম যোগ্যতাসম্পন্ন হলেও নিজেদের পছন্দের কাউকে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদে আসীন করার এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই বর্তমান কমিটি সম্মেলন এত দেরিতে দিয়েছে।’

বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘সম্মেলন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় না, অথচ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের বয়সসীমা ২৯ বছর। ফলে দেখা যায়, একটি কমিটিতে সহ-সভাপতি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করা এবং সাংগঠনিকভাবে দক্ষ এবং নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন কেউ পরবর্তী কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন না। তুলনামূলকভাবে নতুন এবং কম যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে আসায় তাদের শিখতে শিখতেই লেগে যায় দুই বছর।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের সকল সিদ্ধান্তই এখন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেন্দ্রিক। তারা গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করেই নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেন।’

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রেরও বেশকিছু দুর্বল দিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সম্মেলনের তারিখ যেদিন ঘোষিত হবে সেদিন না, সম্মেলন যেদিন অনুষ্ঠিত হবে সেদিন পর্যন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীদের বয়স ২৯ বছরের মধ্যে থাকবে- এ ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। মজার বিষয় হল- গঠনতন্ত্রে পূর্বের উল্লিখিত ২৭ বছরের স্থলে এখনো ২৯ বছরের কথাই উল্লেখ করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটি ২০১ সদস্যবিশিষ্ট হবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকলেও বর্তমান কমিটির সদস্যসংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা কমিটির সদস্যসংখ্যাও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।’

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ নির্বাচন সিন্ডিকেট দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়ে থাকে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কেবল কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, জেলা কমিটির ক্ষেত্রেও গঠনতন্ত্র মানছে না সংগঠনটি। গঠনতন্ত্রের ৯(খ) ধারা অনুযায়ী ‘জেলা শাখার কার্যক্রম এক বছর। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর জেলা শাখাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবনিযুক্ত কর্মকর্তাদের হাতে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের অনুমোদনক্রমে ৯০ দিন সময় বৃদ্ধি করা যাবে। এই সময়ের মধ্যে সম্মেলন না হলে জেলা কমিটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে।’

কিন্তু অধিকাংশ জেলা কমিটির ক্ষেত্রেই এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হলেও বর্তমানে এ কমিটি বহাল রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির নিজ এলাকা বাগেরহাটেও একযুগ ধরে ছাত্রলীগের একই কমিটি বহাল ছিল। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিগত কমিটি ২০১১ সালের ১১ জুলাই গঠিত হলেও তা বহাল ছিল প্রায় চার বছর।

আর অনিয়মিত সম্মেলনের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনটির নেতারা গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে সরকারি চাকরি, শিক্ষকতা, ব্যাংক কর্মকর্তার মতো চাকরিতে যোগদান করেছেন। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজিব চক্রবর্তী, আবু সৈয়দ জিন্নাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল হোসেন দীপু, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক সোহেল রানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও কেন্দ্রীয় ও জেলা ছাত্রলীগের একাধিক পদধারী নেতা চাকরিরত রয়েছেন। অথচ গঠনতন্ত্রের ২(গ) ধারা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেলে কেউ আর ছাত্রলীগে থাকতে পারবেন না।

গঠনতন্ত্রে বিবাহিতরা ছাত্রলীগ করতে পারবে না উল্লেখ থাকলেও ছাত্রলীগের বেশকিছু নেতা কেবল বিবাহিত নন, সন্তান রয়েছে এমন তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংগঠনটি।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসংখ্যা ২৫১ জন হলেও বর্তমান কমিটির সদস্যসংখ্যা ৫০০’র বেশি বলে জানা গেছে। ১৫(ঙ) উপধারায় বলা হয়েছে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সভা বসবে। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম চার বছরে মাত্র দু’বার বৈঠক হয়েছে।

এ ছাড়াও টেন্ডারবাজি, শিক্ষক লাঞ্ছনা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়মে ছাত্রলীগের নেতারা জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগকর্মী তাপস খুন হলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এর আগে রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ খুন হলেও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ জড়িতদের নিজেদের কর্মী বলে অস্বীকার করে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে আদালত ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন।

এ ছাড়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলমকে অস্ত্র ঠেকিয়ে টেন্ডার ছিনতাই করার ঘটনায় জবি ছাত্রলীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বহিষ্কার করলেও তা প্রত্যাহার করে নেয়। অথচ ওই ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মামলা রয়েছে।

গঠনতন্ত্র অনুসরণের বিষয়ে ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘নেতারা গঠনতন্ত্র মেনে চলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। ছাত্রলীগ সবক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।’ সূত্রঃ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই