ছোট্ট একটা ফুলের পাপড়িও পেল না মাবিয়া

ভাবুন তো একবার, জাতীয় ক্রিকেট দল বিদেশ থেকে কোনো সিরিজ জিতে ফিরে এসেছে, কিংবা জাতীয় ফুটবল দল দেশে ফিরেছে কোনো বড় দলকে হারিয়ে। বিমানবন্দরে ঠিক ওই মুহূর্তের পরিস্থিতি কেমন হতো! সংবাদকর্মীরা ভিড় করতেন, বোর্ড কিংবা ফেডারেশনের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে থাকতেন ফুলের মালা নিয়ে। লোকে লোকারণ্য। অগুনতি আলোকচিত্রীর মুহুর্মুহু ক্যামেরার ঝলকানি। টেলিভিশন ক্যামেরাগুলোর হুল্লোড়।

এসএ গেমসের স্বর্ণ-কন্যা মাবিয়া আক্তার শিলং থেকে দেশে ফিরেছেন সদ্যই। বিমানবন্দর দিয়ে নয় অবশ্য। ফিরেছেন সীমান্ত হয়ে। মাবিয়া অত কিছু আশাও করেননি। অত গিজগিজে ভিড়। অত আয়োজন, সংবর্ধনা। কিন্তু নিদেনপক্ষে শুধু একটা ফুলেল শুভেচ্ছা কি পেতে পারতেন না? হলো না কিছুই! এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনার পদক জিতে মাবিয়া দেশে ফিরলেন নীরবে-নিভৃতে। দেশকে সাফল্যের রঙে রাঙানো এই ক্রীড়াবিদ কারও কাছ থেকে পাননি ছোট্ট একটা ফুলের পাপড়ি। একটা ফোন কলও। মাবিয়া অভিমানে কেঁদেছিলেন। হয়তো গোপন সেই কান্না।

সোনার পদক জিতে জাতীয় সংগীতের সুরে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে অঝোর কান্নায় কেঁদেছিলেন মাবিয়া। জাতীয় পতাকাকে স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাঁর কান্না কাঁদিয়েছিল দেশের মানুষকেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই কান্নার দৃশ্য ছড়িয়ে উত্তাল এক আবেগ তৈরি করেছিল সবার মধ্যে। এসএ গেমস হয়তো বিশ্ব মানচিত্রে বড় কোনো ক্রীড়া আসর নয়। কিন্তু তবুও দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের সেই আসরেও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে খুব কমই। কেউ সোনা জিতলেই তবে পদক অনুষ্ঠানে গর্বিত ভঙ্গিতে ওড়ে লাল-সবুজ পতাকা। নেপথ্যে ভেসে আসে সেই সুর, যে সুরের মধ্যে কী যেন একটা আছে, বাংলার মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলে।

মাবিয়ার অর্জনটি আরও বড় ছিল। এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সোনা এনে দিয়েছিলেন তিনিই। দেশকে এমন সম্মান এনে দেওয়া মাবিয়ারা রাজসিক অভ্যর্থনার স্বপ্ন দেখেন না। কিন্তু চান না অবহেলাও। দেশের মাটিতে পা রেখে যখন এতটুকু সম্ভাষণও মেলে না, কেউ পিঠটা পর্যন্ত চাপড়ে দেওয়ার থাকে না; তখন কষ্টে বুক তাঁদের ভেঙে যাওয়াই কি স্বাভাবিক নয়?

এমনিতেই শত অবহেলার বাধা ডিঙিয়ে সোনার পদক জিততে হয় আমাদের ক্রীড়াবিদদের। ভারোত্তোলক মাবিয়া ওজন বিশাল ভারী ওজনের ভার তোলেন, সেই ভারের সঙ্গে মিশে থাকে অনেক প্রতিকূলতা, সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নানা বাধা-নিষেধের গল্পও।

দেশের মাটিতে পা রাখার পর তাঁকে প্রাপ্য সম্মানটুকু না দেওয়ায় আমরা আবার নতুন করেই কী লজ্জিত হলাম না!

মাবিয়ার অবশ্য এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। সারল্যমাখা গলায় বললেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে দেখে আমাদের ফেরার দিনটা কারও মাথায় ছিল না। দেশকে সোনার পদক জিতিয়েছি, এটাই আমার আনন্দ। সোনার পদক জিতেই আমি অনেক সম্মানিত। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে একটা ফুলের মালা না হয়, না-ই বা পেলাম।’

দেশকে যাঁরা দেন, তাঁরা কোনো কিছু ফেরত পাওয়ার আশায় দেন না। মাবিয়া সেই কথাটিই যেন তাঁর মন্তব্যের ভেতর আমাদের সবাইকে নতুন করে বুঝিয়ে দিলেন। এমনিতেই তো না–পাওয়ার অভ্যাস তাঁদের আছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এঁদো জিমনেশিয়ামে ঘামে ভিজে, মশার কামড় খেয়ে বড় কোনো প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের তৈরি করাটা ভারোত্তোলনের মতো খেলার ক্রীড়াবিদদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। বিমানবন্দরে ফুল না পাওয়ার ব্যাপারটা তাদের তাই নতুন করে মন খারাপ করে দেয় না।

‘কষ্ট’ শব্দটার সঙ্গে মাবিয়াদের পরিচয় যে শৈশব থেকেই। ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সেক্রেটারি উইং কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিন আসা-যাওয়ার ভাড়া দিতেন নিজের পকেট থেকে। টাকার অঙ্কটি খুবই ক্ষুদ্র, মাত্র ৫০ টাকা। কিন্তু মাবিয়ার জন্য সেটাই ছিল অনেক বড় কিছু। দোকানি বাবা কী যে কষ্ট করে তাঁদের তিন ভাই-বোনকে বড় করেছেন, সেটা ভেবে আজও শিউরে ওঠেন এই নারী ভারোত্তোলক।
খেলাটিতে শরীর থেকে যে প্রাণশক্তি ক্ষয় হয়, সেটা পুষিয়ে দিতে প্রতিদিন খাদ্য-তালিকায় আমিষের উপস্থিতি আবশ্যক। দুপুরে মাছ হলে রাতে মাংস, কিংবা দুপুরে মাংস হলে রাতে মাছ। সকাল-বিকেল দুধ-ডিমের খরচটা তো আছেই। কিন্তু মাবিয়ার বাবা কষ্ট হলেও মেয়েকে এগুলো জুগিয়ে গেছেন। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের খেলাধুলাকে নিরুৎসাহিত করার যে প্রবণতা আছে, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা হঠাৎ বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনের ঠোঁট উল্টে করা কটুকাটব্যগুলো পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বারবারই মনে পড়ছিল মাবিয়ার।

যতই বলুন কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো অভিযোগ নেই; সোনা জয়ের পর সরকারের তরফ থেকে নিদেনপক্ষে একটি ফোন কলের আশা করেছিলেন মাবিয়া। সেটা তিনি নিজের মুখেই বললেন, ‘দেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের কারও একটা ফোন পেলে খুব ভালো লাগত। আমরা তো দেশের জন্যই খেলি। সব সময় সঙ্গে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হয়তো তাঁদের সময় হয়নি। তবে কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’

নিজের জন্য কোনো চাওয়াও নেই। বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা চাইছেন না। চাইছে যে ভারত-শ্রীলঙ্কার প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়তে হয়, অন্তত তাদের মানের প্রশিক্ষণ সুবিধা যেন দেশের ভারোত্তোলকেরা পায়। ‘আমরা কী পরিবেশে অনুশীলন করি। কী ধরনের পোশাক বা কোন ব্র্যান্ডের জুতা পরি, এসব শুনে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান বন্ধুরা খুব অবাকই হয়েছে। আমাদের বারবার বলছিল, “কীভাবে তোমরা এমন অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভারোত্তোলনের মতো একটি খেলা খেলার সাহস পাও!” আমরা কেউই তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারিনি’—বলছিলেন তিনি।
এসএ গেমসের ঠিক আগেই অনুশীলন করতে গিয়ে হাতের হাড় ভেঙে গিয়েছিল মাবিয়ার। গেমসেও ৮২ কেজি তিনি তুলেছেন ভাঙা হাড় ঠিকমতো জোড়া লাগার আগেই। প্রসঙ্গটা তুলতেই হেসে ফেললেন। যেন কোনো ব্যাপারই নয়।
জীবন-যুদ্ধে জয়ী মাবিয়ার কাছে কোনো কিছুই এখন আর অসম্ভব মনে হয় না।



মন্তব্য চালু নেই