জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত : প্রশ্নের মুখে সরকার

একের পর এক বিরোধীদলীয় স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের ঘটনায় এখন রীতিমতো বিতর্কের মুখে পড়েছে সরকার। সর্বশেষ গত রোববার এক দিনে বিএনপিদলীয় দুই মেয়র ও গত এক সপ্তাহে দুই চেয়ারম্যান ও এক ভাইস চেয়ারম্যানকে বরখাস্তের ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশে।

বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ১৩২টি দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে দেশে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলন চলাকালে এমন ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে সরকারকে।

এ নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরেও চলছে তুমুল সমালোচনা। বরখাস্তের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ওই বৈঠকে আইপিইউ সম্মেলন চলাকালীন সময়ে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার ঘটনাটি সামনে আসায় অংশগ্রহণকারী অতিথিদের মাঝে গণতান্ত্রিক চর্চায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে উল্লেখ করে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে ঘটেছে। ফলে এসব বরখাস্ত কাদের সিদ্ধান্তে হচ্ছে-প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তড়িঘড়ি বরখাস্তের বিষয়টির পশ্চাতে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে স্থানীয় সরকার প্রশাসন।

অবশ্য বরখাস্তের দুই দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে দ্বিতীয় এবং হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছকে তৃতীয় দফায় সরকারের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক গত বৃহস্পতিবার মেয়রদের বরখাস্ত আদেশে স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

যদিও স্থানীয় সরকার বিভাগের আইনে বলা আছে, কোনো জনপ্রতিনিধি ফৌজদারি আইনে অভিযুক্ত হলে তাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিধান আছে। আর এ বিধান অনুযায়ী বরখাস্ত হয়েছেন মেয়ররা। কিন্তু ঢাকায় এত বড় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলাকালে এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও। দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, বরখাস্তের ঘটনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে হয়নি।

এ নিয়ে রাজনীতিতেও চলছে এক ধরনের উত্তেজনা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। দল থেকে বলা হচ্ছে, সরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়র বা জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছে।

এমনকি বিএনপি নেতারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করার যে বিধি সরকার প্রয়োগ করছে, সেটাকে ‘কালো আইন’ বলে দাবি করছেন। তারা এ আইনের সংশোধনও দাবি করেছেন।

আর এসব বরখাস্তের ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে কেবল স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডেই বিঘ্ন ঘটবে না; ভোটের রাজনীতিতেও সরকারকে খেসারত দিতে হবে বলেও মনে করেন তারা। তাদের মতে, এটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি এমন ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি জন্ম দেবে বলেও আশঙ্কা তাদের।

সরকারের বিভিন্ন সূত্রে ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিশেষজ্ঞদের দেওয়া মতামত থেকে এমন তথ্য মিলেছে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, গত রোববার এক দিনেই রাজশাহী ও সিলেটের দুই মেয়র এবং হবিগঞ্জের এক পৌর মেয়রের পাশাপাশি গত মঙ্গলবার আরো দুই চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এরা হলেন মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও ভাইস চেয়ারম্যান জার্জিস হুসাইন।

২০১৩ সালে হরতাল-অবরোধের সময় পুলিশের ওপর হামলা মামলার আসামি হিসেবে বিএনপির এ দুই জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। এভাবে গত আড়াই বছরে বিরোধীদলীয় তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন সিটি মেয়র ছাড়াও ২১ পৌর মেয়র, ৪৪ কাউন্সিলর, ৪৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৫৮ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৮৬ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ৫৪ জন ইউপি সদস্য রয়েছেন।

বিশেষ করে গত কয়েক মাসে সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ৭০ জনেরও বেশি জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করেছে সরকার।

কেন এই বরখাস্ত-জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় যাদের বরখাস্ত করেছে, তাদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত জোটের জনপ্রতিনিধি। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনবিরোধী এবং বর্তমান আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের যেসব জনপ্রতিনিধি জড়িত ছিলেন, তারাই বরখাস্ত হচ্ছেন।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এমনও বলছেন, বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের কেউই শপথগ্রহণের পর ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। বাস্তবায়িত হয়নি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার। নির্বাচিত মেয়ররা দায়িত্বে না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নগরীগুলোর উন্নয়ন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, বিএনপির মনোনয়ন বা সমর্থনে মেয়র হওয়া এসব জনপ্রতিনিধি জ্বালাও-পোড়াও ও হত্যা মামলার অভিযোগে অভিযুক্ত। কিন্তু যে সময়টাতে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, তা তাদের পক্ষে চলে গেছে। আর সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।

তবে বিএনপি-জামায়াতের মনোনয়ন বা সমর্থনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা মাথা গুঁজে শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, তাদেরকে হয়রানি করবে না সরকার। আর চেয়ারে বসে দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে তৎপর ছিলেন বা হতে পারেন-এমন জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান বজায় রাখবে সরকার। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের জনপ্রতিনিধির চেয়ার থেকে দূরে রাখতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগত সব ধরনের বাধা অব্যাহত রাখবে সরকার।

তবে বিষয়টি ‘সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন দুই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। তাদের একজন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তের ঘটনায় তৃণমূল তো বটেই, সারা দেশেই সরকারের ভোটের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এরা সবাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত। ফলে দলমত নির্বিশেষে ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হবে। সরকার বুঝতে পারছে না তাদের ক্ষতি হবে।

অপর বিশেষজ্ঞ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কেবল তৃণমূলই নয়, জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হলো। ভবিষ্যতে অন্য দল ক্ষমতায় এলে এখনকার লোকজনদের এসব প্রতিষ্ঠানের কাছেই ঘেষতে দেবে না। এটি কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্যও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা।



মন্তব্য চালু নেই