জন্মদিনে তুমি এত মলিন কেন?

৯৪তম বছর পেরিয়ে ৯৫ বছরে পা রেখেছে এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সবচেয়ে পুরানো উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় এক সেঞ্চুরিতে এই প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে অনেক গৌরব ও ঐতিহ্য। কিছুকাল আগেও এই প্রতিষ্ঠানটি ঘিরেই জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিসহ সবকিছুই পরিচালিত হত। এখান থেকেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সব ধরনের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের।

সেই ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, ‘৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন, ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সবর্শেষ ১/১১ সরকার বিরোধী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে এটি। মধুর ক্যান্টিন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী । জরাজীর্ণ দেয়াল, ভাঙা চেয়ার, টেবিল সব কিছুতেই রয়েছে অনেক স্মৃতি, ইতিহাসের পরম স্পর্শ। হাজারো হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের নীরব সাক্ষী হয়ে এখনো গৌরবের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এই প্রতিষ্ঠানটিও জন্ম দিয়েছে অনেক বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবাঙালী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অল্প সময়ের জন্য আমিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।এর আগে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ নানা জাতীয় দিবসে এই প্রতিষ্ঠানে পদচারণা ছিল প্রাক্তণ শিক্ষার্থীদের। আমরা সবাই একে নিয়ে অনেক গর্ব করতাম। বুক ফুলিয়ে পরিচয় দিতাম।

কিন্তু আজ ৯৫তম জন্মদিনে দলবাজ-চাটুকর উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারদের মনে আনন্দ জাগতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে আজ অনেক বেদনা উকিঁ দিচ্ছে। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, কিছুকাল আগেও প্রতিষ্ঠানটি যে ধরনের গৌরব ধারণ করেছিল সেই জৌলুস আর নেই। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আগের মতো সেই আগ্রহ নেই। সেই টিএসসি চত্বরে নেই আগের মতো মানুষের ভিড়। ক্রমেই মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে এর প্রতি । অনেকের মনে ঘৃর্ণাও জন্ম দিয়েছে। শাহবাগ চত্বরে ও শাহাবাগের চা-স্টলে আড্ডা দেয়ার মতো নিজেরও আগের সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এখন ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হাঁটলে কেনজানি এক ধরনের ভুতরে লাগে, ভয়ে চকচক করে। এ অবস্থা শুধু আমার নয়, আরো অনেকের। অবশ্য এমন আতঙ্কজনক পরিবেশ এমনিতেই হয়নি, এরপেছনে নানা কারণ নানা ঘটনা রয়েছে। যা আমাদের সবারই জানা। তাই এখানে পুনরুল্লেখ করে পাঠকের বিরুক্তি ঘটাতে চাই না।

এ বছর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীর মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নেয়া হয়েছে ‘উচ্চশিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন’।

তাই প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রতি খেয়াল করে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে- উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপিঠ এখানে সত্যিকার অর্থেই কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, না অন্যকিছু! মানুষ গড়ার এই কারখানায় আজ সত্যিই কি মানুষ গড়ছে? না, নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে?

আজ বারবার স্মরণে পড়ছে এইত ক’দিন আগের পহেলা বৈশাখের ঘটনা- যেখানে আমার মা-বোনদের প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, যেখানে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে আমার ভাই আবুবকর, অভিজিৎকে। যেখানে প্রতিনিয়ত আমার শিক্ষার্থী বোনকে যৌন হয়রানি করছে শিক্ষক নামদারী লম্পটরা। আজ যখন প্রতিষ্ঠানটি ৯৫তম জন্মদিন পালন করছে ঠিক সেদিনও ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এরমধ্যে একজনকে বহিষ্কার ও অন্যজনকে বাধ্যতামূলক ছু্টিতে পাঠানো হয়েছে।

সবচেয়ে বেশী উদ্বেগের বিষয় হলো- এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নৈতিকতার অবক্ষয় নিয়ে। তাদের একটি অংশের নৈতিকতা যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তাতে আমাদের সামাজিক বন্ধন ও কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপীঠ। যেখান থেকে সুনাগরিক বের হবার কথা আজ সেখানেই বারবার নারীর বস্ত্র হরণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে। সেখানেই প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন করা হচ্ছে মানুষকে। সেখানেই প্রকাশ্যে আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা হচ্ছে। তাহলে আমাদের উচ্চশিক্ষার অর্থ কী! বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী শিখছি, আমাদেরকেই বা শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছেন!

পহেলা বৈশাখের দিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে সর্বমহলে ব্যাপক হৈচৈ হলেও টনক নড়েনি জাতির। হাইকোর্ট রুল জারি ও দেশের সর্বস্তরের মানুষ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও গ্রেফতার হয়নি জড়িতরা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি তাদের।

বাঙালির প্রাণের উৎসবে এ ধরনের ন্যাক্কার ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই । তবে সহসাই সবার মনে প্রশ্ন জাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে এই ৩০-৩৫ জনের যুবকদলের সদস্যরা কারা। তাদের পরিচয়ই বা কী? কোন শক্তির বলে এরা প্রকাশ্যে শত শত মানুষ ও পুলিশ প্রশাসনের সামনে জাতির ঘারে আরেকটি কলঙ্কলেপন করতে দ্বিধা করেনি।

কিন্তু এসব ঘটনায় সবাই বিস্মিত হলেও আমার কাছে মোটেও তেমনটি মনে হয়নি। কারণ আমাদের সমাজ যে অধপতনের দিকে এগুচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে কার্যত: আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। আমরা যেন অসভ্যতার দিকে ফিরে যাচ্ছি।

আমরা সবাই জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা তারুণ্যের উচ্ছলতার চারণক্ষেত্র। এটা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন দিবসে বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের মতো বাঙালীর জাতীয় উৎসবের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তারুণ্যের উচ্ছাসে ভরে থাকে, তরুণ-তরুণীর পদভারে মুখরিত থাকে এ এলাকা। এ সংস্কৃতি আমাদের অনেক পুরানো।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ষবরণে এ ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়েছি।হয়েছি বিস্মিত। কেননা, একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সমাজে দেশের সবোর্চ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এ কী কান্ড! প্রকাশ্যে দিবালোকে নারীদের ইজ্জ্বতহরণ হচ্ছে, আর আমরা হাজার হাজার মানুষ আর প্রশাসন মিলে সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে অবলোকন করলাম!

কয়েক বছর আগে ইংরেজি নববর্ষ পালনের সময় একটি মেয়েও এরকম যৌননীপিড়নের শিকার হয়েছিলো এই টিএসসি এলাকায়। সেদিন একজনও এগিয়েতো আসেনিই বরং এ মেয়েটিকে নিয়ে নানা রসাত্মক গল্প ছড়িয়েছে কটু মন্তব্য করেছি আমরা সবাই মিলে। সেদিন রাতে যা ঘটেছিলো আজ তা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটিয়েছে বখাটেরা। শুধু টিএসসি চত্বরেই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের আরো অনেক ছোটখাট ঘটনা অহরহ ঘটছে।

এরা কারা তা সবাই আমরা চিনি বলেই পুলিশ তাদের ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। কেন ছেড়ে দিয়েছে? ওইসব বখাটেদের খুটির জোর কোথায়? সহসাই প্রশ্ন জাগে ওদেরকে কি রাষ্ট্রের আইনশৃংখলাবাহিনীও ভয় পায়? অন্যথা রাষ্ট্র যদি এদের লালন করে তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেবে কে? আমরা কোথায় যাবো?

শুধু তাই নয়, আজ দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে মানব সভ্যতার উন্নতির পরিবর্তে প্রতিনিয়ত অবক্ষয় ঘটছে। ফলে আমাদের সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আর তাই এ ধরনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক প্রতিবাদে সবার এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথা এ সমাজ-সভ্যতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এদের দমনের জন্য আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত । এ বছর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীর মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নেয়া হয়েছে ‘উচ্চশিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন’। এ ধরনের বিষয়ের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলবো এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার চেয়ে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নৈতিক শিক্ষা। উচ্চশিক্ষাঙ্গনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৈতিক শক্তি গড়ে না উঠলে কোনোদিনই দেশে উচ্চশিক্ষা টেকসই উন্নয়নের সুফল বয়ে আনতে পারবে না।

কলাম লেখক, শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক। ই-মেইল:[email protected]



মন্তব্য চালু নেই