প্রাকৃতিক ভূস্বর্গ ভারতের কাশ্মির : পর্ব-১

জম্মু থেকে একমাত্র দূর্গম পাহাড়ি পথে রয়েছে আড়াই কি.মি’র জওহার ট্যানেল

হঠাৎ-ই দূর্গম পাহাড়ি রাস্তার দু’প্রান্তে লম্বা গাড়ির লাইনের জ্যাম বেধে গেলো। যেনো তেনো লাইন নয়, নিদেনপক্ষে ১০/১২ কিলোমিটার তো হবেই। জ্যামের কারণ আর কিছুই নয়, শতশত ছাগল ও ভেড়ার পাল।

ঐতিহ্যপূর্ণ, মনোমুগ্ধকর ও প্রাণ জুড়ানো প্রকৃতির সমারোহ, ডাল লেক, এশিয়ার বৃহৎ জামে মসজিদ, বিঘার পর বিঘা আপেল বাগান, ব্যতিক্রমী ও দৃষ্টিনন্দন গাছগাছালি, ক্রিকেট ব্যাট তৈরী, পাহাড়ের নিচে ট্যানেল, বিভিন্ন গার্ডেন ও পার্ক, বিশ্বের বৃহৎ জাফরং উৎপাদন এলাকা, সম্পূর্ণ পাথরের পাহাড়-পর্বত, পাথর বেষ্ঠিত বরফ গলা নদী, প্রাচীন রাজাদের দূর্গ, মখদুম শাহর দরবার, হযরত বাল দরগাহ শরীফ, ভয়ংকর যুদ্ধ এলাকা খ্যাত কার্গিল, প্রগৈতিহাসিক পাহাড়ি এলাকা লাদাখ সহ ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ ভারতের জম্মু ও কাশ্মির (জে.কে) রাজ্য। প্রকৃতি যে কত সুন্দর, মনোরম ও নিষ্পাপ হতে পারে তা কাশ্মিরকে না দেখলে বোঝা যায় না। অনেকেই কাশ্মিরকে প্রাকৃতিক ভূস্বর্গ আখ্যা দিয়ে থাকেন। সত্যি স্বচক্ষে না দেখলে তা অনেকটাই অনুধাবন করা যায় না।

ভারতের দীর্ঘদিনের গোলযোগপূর্ণ ও উগ্রপন্থিদের ভয়ংকর কালো থাবায় জর্জড়িত ছিল কিংবা মতান্তরে আছে জম্মু ও কাশ্মির (জে.কে) রাজ্যটি। ১৯৮৯সাল থেকে ২০০৯সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যটি উগ্রপন্থি ও কথিত স্বাধীনতাকামীদের ভয়ংকর স্বশস্ত্র মহড়ায় ছিল প্রকম্পিত। সেনা, পুলিশ ও বিএসএফসহ আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর সাথে উগ্রপন্থিদের স্বশস্ত্র যুদ্ধ ছিল প্রতিক্ষনের ঘটনা। স্থানীয়রা জানালেন ওই ২০ বছরে উগ্রপন্থি কিংবা সেনাদের হাতে লাখ লাখ যুবক মারা গেছে। এর ভয়াবহতা এতোটাই ছিল যে কোন পিতা তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য ছেলে পেতো না। পাকিস্থানের আজাদ কাশ্মির থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে স্বশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছিল উগ্রপন্থিরা। আর উগ্রপন্থিদের শেষ পরিণতি ছিল নিশ্চিত মৃত্যু, জেল কিংবা নিখোজের ঘটনা। এমনটাই জানালেন স্থানীয়রা।

তবে ২০০৯সালের পর থেকে এ অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। এখন আর প্রকাশ্যে কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না। বেশ শান্ত ও স্বাভাবিক ওই এলাকায় বর্তমানে পথে পথে ও পায়ে পায়ে সেনা, পুলিশ, বিএসএফসহ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও মহড়া খুবই চোখে পড়ে।

যাহোক, ভ্রমণ পিপাসূদের জন্য বর্তমানে কাশ্মির খুবই আকর্ষণীয় ও হৃদয়স্পর্শী প্রাকৃতিক নৈস্বর্গ মন্ডিত ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক নিদর্শনপূর্ণ এলাকাও বটে।

জম্মু ও কাশ্মির (জে.কে) রাজ্যের দুটি রাজধানী। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর ও শীতকালীন রাজধানী হলো জম্মু। ভারতের সবচেয়ে উত্তরের সর্বশেষ ট্রেন জংশন বা স্টেশন হলো জম্মু। পাহাড় কেটে শ্রীনগর পর্যন্ত একক ও ছোট ট্রেন লাইন সম্প্রসারণের কাজ বর্তমানে চলমান। পাহাড় থেকে নেমে আসা তাওউই নদীটির দু’তীরে গড়ে উঠেছে জম্মু শহরটি। আর মূলত এ কারনেই ওই স্টেশনটির নামও জম্মু তাওউই স্টেশন।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে আকাশপথে প্লেনযোগে জম্মু ও শ্রীনগরে যাওয়া যায়। তবে সাধারণত শ্রীনগর থেকে জম্মু প্লেনযোগে ও সেখান থেকে নয়াদিল্লি রেলপথে যাতায়াত করে থাকেন সেখানকার উচ্চবিত্ত বাসিন্দারাও। এছাড়া সড়ক ও রেলপথেও যাতায়াত করা হয়ে থাকে। তবে মানুষের সবচেয়ে বেশি যাতায়াত রেলপথে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা থেকে প্রায় ২হাজার কিলোমিটার দূরত্বের জম্মু শহরটি সম্পূর্ণ পাহাড়ের উপর অবস্থিত। কোলকাতা (চিতপুর) স্টেশন থেকে জম্মু তাওউই এক্সপ্রেস, হাওড়া স্টেশন থেকে হিমগিরি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে শিয়ালদহ এক্সপ্রেস নামের ট্রেনগুলো নিয়মিত যাতায়ত করে।
কোলকাতা থেকে জম্মু পর্যন্ত ট্রেনে যেতে দুই রাত দেড় দিনের মতো সময় লাগে।

আর জম্মু থেকে শ্রীনগরের ২৯৪ কিলোমিটার দূরত্বের পথটি সম্পূর্ণ দূর্গম পাহাড়ি রাস্তা। শুধু তাই নয়, ওই ‘রাস্তাটি’ই জম্মু থেকে শ্রীনগর যাতায়াতের ‘একমাত্র’ পথ। কোন কারণে রাস্তা বন্ধ থাকলে কিংবা শীত মৌসুমে ব্যাপক বরফ পড়ে ওই রাস্তাটি বন্ধ হয়ে পড়লে জম্মু থেকে সড়কপথে শ্রীনগর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বলে জানান স্থানীয়রা। প্রায় ৩’শ কিলোমিটার দূর্গম ওই পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগে কমপক্ষে ৮/১০ ঘন্টা। জম্মু থেকে শ্রীনগর বাস, মিনিবাস, টাটা শুমো, জিপ, পাজেরো ইত্যাদি যাত্রী বহন করে থাকে।

বৃহৎ পাহাড়-পর্বতগুলো এতোটাই মনোরম, সুন্দর ও সাজানোগুছানো যেন দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাহাড় কেটে ও পাহাড়ের গা ঘেষে দূর্গম রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে উপরের দিকেও যেমন শেষ দেখা দুষ্কর তেমনি নিচের দিকে শেষপ্রান্ত দেখা যায় না বললেই চলে। জম্মু থেকে শ্রীনগরের পথিমধ্যে পাহাড়ের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে আড়াই কিলোমিটার ব্যাপী একটি একটি ট্যানেল রয়েছে। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ‘জওহার ট্যানেল’ নামের ওই বড় সুড়ঙ্গ পথটি কোন কারণে বন্ধ থাকলেও জম্মু-শ্রীনগর সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বর্তমানে পাহাড় কেটে ও পাহাড় ছিদ্র করে কয়েকটি সুড়ঙ্গ পথ বা ট্যানেল ও রাস্তা সোজা করার কাজ চলছে। চলছে মিটার গেজ টাইপের একক ছোট ট্রেন লাইনের কাজ।

চলবে… ৬টি পর্ব…

লেখক:
আরিফ মাহমুদ
সম্পাদক
আওয়ার নিউজ বিডি ডটকম



মন্তব্য চালু নেই