জাকাত কাকে, কখন, কিভাবে দেবেন?

জাকাত ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমাতিক্রমকারী সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) অংশ বছর শেষে বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ এবং জাকাতই শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ – يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ

অর্থ: আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার। [৯:৩৪-৩৫]

ত্রিশতম পারার সূরা হুমাযা পুরোটাই জাকাত প্রদান না করার শাস্তির আলোচনায় উৎসর্গিত-
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ – الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ – يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ – كَلَّا ۖ لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ – وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ – نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ – الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ – إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ – فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ

অর্থ: প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ, যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে। সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে। কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কি? এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে, লম্বালম্বি খুঁটিতে। [১০৪:১-৯]

বস্তুত, সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানাকে ইসলাম স্বীকার করে নিলেও, এ সুযোগে যেন অশুভ পুঁজিতন্ত্র জন্ম লাভ না করতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ রোধে তাই জাকাতকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি।

ইসলাম মনে করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বাদ দেয়ার পর কারো যদি ৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা সমমূল্যের সম্পদ এক বৎসর কাল পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তাহলে সে সম্পদশালী। এ ধরনের সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে রাষ্ট্রের অন্যান্য অভাবী মানুষদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ওই সঞ্চিত সম্পদের শতকরা ২.৫ টাকা জাকাত প্রদানের দাবি জানায় ইসলাম।

জাকাত কখন ফরজ হয়:
৭.৫ ভরি স্বর্ণ, ৫২.৫ ভরি রূপা বা সমমূল্যের নিত্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে, এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে। এ হিসাবটাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নেসাব বলে। অতএব, কারো যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে, তাহলে তার উপর জাকাত ফরজ হবে।

কাকে জাকাত দেয়া যাবে:
১. মিসকীন: যার কোনো সম্পদ নেই, মানুষের কাছে হাত পেতে চলে।
২. অভাবী: যার সম্পদ আছে, তবে নেসাব পরিমাণ নেই, কারো কাছে হাতও পাতে না সে, অথচ সে তার প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। এ কাতারে ঋণ আদায়ে অক্ষম ও ভিনদেশি অভাবী মুসাফিরও পড়বে। চিকিৎসা গ্রহণে অক্ষম ব্যক্তিও এ কাতারে শামিল। অর্থাৎ কেউ যদি এমনিতে সচ্ছল হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে অক্ষম হয়, তাহলে তাকেও জাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। তবে শর্ত হলো, চিকিৎসার পর্যায়টা এমন হতে হবে যে, যা না করালেই নয়, এবং যে চিকিৎসা করালে তার সুস্থতাও অনেকটা নিশ্চিত।

উদাহরণস্বরূপ, যে চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব, তা যদি সিরফ বিলাসিতা বশত বিদেশে গিয়ে করাতে চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে জাকাত দেয়া যাবে না। কিন্তু চিকিৎসকরা যদি বলেন যে, তাকে অমুক দেশে নিতেই হবে, এছাড়া কোনো গতি নেই, তখন তাকে সাহায্য করা যেতে পারে। মোটকথা, চিকিৎসা যদি কারো সত্যিই প্রয়োজন হয়, এবং এ প্রয়োজন মেটাতে যদি সে সত্যিই অক্ষম হয়, তাহলে সেও এই অভাবীর পর্যায়ভুক্ত হয়ে জাকাত গ্রহণ করতে পারবে।

তবে দুই সম্পর্কের মানুষকে জাকাত দেয়া যাবে না:
১. ঔরসজাত সম্পর্ক। যেমন- পিতা ছেলেকে বা ছেলে পিতাকে।
২. বৈবাহিক সম্পর্ক। যেমন- স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামী।

জাকাত বিষয়ক কিছু জরুরি জ্ঞাতব্য:
১. জাকাতের ক্ষেত্রে নিয়ত করা (জাকাত দিচ্ছি এই জ্ঞান করা) আবশ্যক। সেটা প্রদান করার সময়ও হতে পারে বা জাকাতের সম্পদ হিসাব করে পৃথক করার সময়ও হতে পারে।
২. প্রতিটা সম্পদের উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরি নয়। বরং বছরের মাঝে যে সম্পদ অর্জিত হবে, তাতেও জাকাত আসবে।
৩. জাকাত আদায়ের তারিখে যে যে সম্পদ থাকবে, সে সে সম্পদের জাকাত আদায় করবে।
৪. জাকাতের পরিমাণ নির্ধারণে মনগড়া/অনুমাননির্ভর হিসাব করবে না। বরং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে জাকাত আদায় করবে। যেন কোনো ক্রমেই পরিমাণের চেয়ে কম আদায় না হয়।
৫. জাকাত যেদিন হিসাব করে পৃথক করবে, সেদিনের মূল্য ধর্তব্য হবে।



মন্তব্য চালু নেই