জাকির নায়েকের অনুদান নিয়ে ভারতে বিতর্ক তুঙ্গে

জাকির নায়েকের এনজিও ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫০ লাখ টাকার অনুদান পায় সোনিয়া গান্ধী পরিচালিত রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট৷ তাই নায়েকের বেআইনি গতিবিধি প্রকাশ্যে আসায় ওই টাকা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। খবর ডিডব্লিউর।

গুলশান হামলাকারীদের দু’জন পিস টিভির কর্ণধার ড. জাকির নায়েকের টুইটার-অনুসারী ছিলেন৷ তাঁর বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে পিস টিভিতে প্রচার হতো এবং তাতে জঙ্গি তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো উপাদান ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তাই ড. নায়েকের সঙ্গে কংগ্রেস সভানেত্রী পরিচালিত এনজিও-টির একটি সম্পর্ক বেরিয়ে আসায়, বিষয়টিকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে মাঠে নেমেছে বিজেপি৷ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনের মুখে স্বাভাবিকভাবেই এটি বিজেপির মোক্ষম হাতিয়ার৷ অবশ্য ভারতের বিতর্কিত এই বক্তার বেআইনি গতিবিধি প্রকাশ হওয়ার পর, অনুদান বাবদ পাওয়া সেই অর্থ ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কংগ্রেস৷

এরপরও বিতর্কিত ধর্ম প্রচারক জাকির নায়েক পরিচালিত এনজিও মুম্বাই-ভিত্তিক ইসলামিক রিসার্চ ফাইন্ডেশন বা আইআরএফ ২০১১ সালে গান্ধী পরিবার পরিচালিত এনজিও রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান কেন দিয়েছিল, এর পেছনে অন্য কোনো অভিসন্ধি আদৌ ছিল কি না – তা নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশই বাড়ছে৷ উত্তর প্রদেশ এবং পাঞ্জাবের আসন্ন নির্বাচনের মুখে কংগ্রেসকে চেপে ধরতে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের অভিযোগ, কংগ্রেস সরকারের আমলেই এই টাকা দেয়া-নেয়া হয়েছিল৷ তাহলে কি বুঝতে হবে যে, জাকির নায়েকের দেশবিরোধী আপত্তিকর গতিবিধি আড়াল করতেই এই অর্থ ঘুষ হিসেবে দেয়া হয়েছিল?

তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী কংগ্রেসের মনিশ তেওয়ারি ২০১২ সালে একবার সংসদে বলেছিলেন, সরকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাকির নায়েকের পিস টিভিসহ অনেকগুলো টিভি চ্যানেলের দিকে নজর রাখছে৷ তাই যদি হয়, তাহলে কংগ্রেসের বক্তব্য অনুযায়ী সেই অর্থ ২০১২ সালেই কেন ফিরিয়ে দেয়া হলো না? রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন প্রথমে অনুদানের কথা অস্বীকার করলেও, পরে স্বীকার করে যে আরজিএফ-এর সহযোগী রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে দেয়া হয়েছিল ওই অনুদান৷ এটা কি খবরটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা নয়? বলা বাহুল্য, এ প্রশ্ন বিজেপির৷ তবে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, উত্তর প্রদেশ বিধানসভার আসন্ন ভোটে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে জঙ্গিবাদের মদতদাতা জাকির নায়েকের যোগসূত্রের কথা নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই জনসমক্ষে তুলে ধরতে চাইছে বিজেপি৷

অন্যদিকে, বিতর্কের অভিমুখ ঘোরাতে আত্মপক্ষ সমর্থনে কংগ্রেসের বক্তব্য: প্রথমত, রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে (আরজিসিটি) জাকির নায়েকের এনজিও ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ) যখন অনুদান দিয়েছিল, তখন জাকির নাইকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদ দেবার কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ কিন্তু এ বছরের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই জাকির নায়েকের নাম উঠে আসে৷ তাই নায়েকের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্কটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না৷ একমাত্র জ্যোতিষিদের পক্ষেই সেটা বোঝা সম্ভব৷ তবে খবরটি প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয়ত, রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে দেয়া অনুদান অবৈধ নয়, কারণ ২০১০ সালের বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনে শুধু আরজিসিটি নয়, ড. নায়েকের সংস্থা আইআরএফ-কেও নথিভুক্ত করা হয়৷ ওই আইন অনুসারে নথিভুক্ত দু’টি এজিওর মধ্যে অর্থ বিনিময় অবৈধ নয়৷

ঢাকার মতে, গুলশান হামলার সঙ্গে যুক্ত দু’জন বাংলাদেশি যুবকের মস্তিষ্ক ধোলাই করে সন্ত্রাসী খাতায় নাম লেখাতে প্ররোচিত করেছিলেন ওই বিতর্কিত ধর্ম প্রচারক৷ আর সেজন্য তাঁর উপগ্রহ পিস টিভিকে কাজে লাগানো হয়েছিল, যা প্রচারিত হতো দুবাই থেকে৷ গুলশান হামলার পর তাই পিস টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ এবং ভারতকেও অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে হাসিনা সরকার৷ হালে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী দিল্লি সফরে এসে মোদি সরকারকেও এই বার্তা দিয়ে যান বেশ জোরালোভাবে৷ তাঁরা বলেন, দিল্লি ও ঢাকা সন্ত্রাস দমনে একে-অপরের হাত শক্ত করতে সব রকম সহযোগিতা করে যাবে৷

ভারত কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

সম্প্রতি ভারতেও সরাসরি পিস টিভি সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ বাতিল করা হয়েছে মুম্বইতে জাকির নায়েকের এনজিও ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রেজিস্ট্রেশনও৷ এছাড়া গত সপ্তাহে নতুন দিল্লিতে, ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের বিদেশ সচিব জঙ্গিবাদ মোকাবিলার পাশাপাশি ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেও বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য বিশ্বের সমর্থন চেয়েছেন৷ তাঁর কথায়, বাংলাদেশের কঠিন সময়ে ভারত সর্বদাই বাংলাদেশের পাশে থেকেছে৷ সুতরাং এবার বিশ্বেরও উচিত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো৷ মুম্বইতে ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নথিপত্র পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে৷ এবং তার জন্য আপাতত দপ্তরটি বন্ধ রাখা হয়েছে বলে খবর৷

গুলশান সন্ত্রাসী কাণ্ডের সময় জাকির নায়েক অবশ্য বিদেশে ছিলেন৷ ভারতে এলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে, এই আশঙ্কায় এখনও তিনি দুবাইতে রয়েছেন৷ সেখানে বসেই তিনি ই-মেলে ভারতের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার বা জোর করে ধর্ম বদল করার অথবা যুবকদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের অভিযোগ কতটা সত্যি সে সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ পেশ করা হোক৷ ভারতের আদালত তাঁর নিরপেক্ষ বিচার করবে৷ তবে হ্যাঁ, জাকির নায়েক বিদেশে থাকলেও মুম্বইতে তাঁর ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সদরদপ্তর রয়েছে৷

ওদিকে ভারতের নাগরিক সমাজের একটা অংশের প্রশ্ন, জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলে, কট্টর হিন্দুত্ববাদ প্রচার করাও কি একই বন্ধনীভুক্ত নয়? প্রশ্নটা বিতর্কিত হলেও ভেবে দেখার অবকাশ আছে৷ কারণ কোনো উগ্রবাদই তো সমর্থনযোগ্য নয়, তাই না? –ডিডব্লিউ



মন্তব্য চালু নেই