জাতিগত দাঙ্গা তদন্তে গিয়ে রাখাইনদের রোষানলে কফি আনান

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব জাতিগত দাঙ্গা বিষয়ে তদন্ত করতে মিয়ানমারে পৌঁছেছেন। তবে তদন্তে গিয়ে নিজেই বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন তিনি। শিকার হয়েছেন রাখাইনদের বৈরী মনোভাবের।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা কথিত গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির অনুরোধে এই উপদেষ্টা কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে সম্মত হন কফি আনান। সু চি দাবি করেছেন, পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের সংকীর্ণ-ধর্মবোধ থেকে জন্ম নেওয়া তিক্ত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সমাধানের পথ দেখাবে ওই কমিশন। এই লক্ষ্যেই ৯ সদস্যের কমিশন গঠন করেছে মিয়ানমার সরকার। এদের ছয়জন মিয়ানমারের এবং কফি আনানসহ বাকি তিনজন বিদেশি।

বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকারের গঠিত ওই ‘রাখাইন রাজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা কমিশনের’ হয়ে তিনি মিয়ানমারে গেছেন। মঙ্গলবার তিনি ওই কমিশনের প্রধান হিসেবে মিয়ানমারে পৌঁছান।

দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চলে আসছে রাখাইন বৌদ্ধ ও রাজ্যটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে। দেশটিতে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়, এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদীরা জোর দিয়ে বলে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। তারা রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বাঙালি’ বলে থাকে। তিক্ততার ফলে ২০১২ সালে রাখাইনে ভয়াবহ মুসলিমবিরোধী সহিংসতা সংঘটিত হয়। ১ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। তাদের মানবেতর জীবনযাপন পরিস্থিতি এবং চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রচুর মানুষকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে। রাখাইন রাজ্যের একটি সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গেও রয়েছে। তাই বাংলাদেশ একটা লক্ষ্যবস্তু। অনেকেই আবার সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া চলে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন।

মঙ্গলবার রাখাইন রাজ্যের রাজধানীর সিত্তেতে পৌঁছার আগেই কফি আনান সাংবাদিকদের জানান, রাখাইনে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং পুনর্মিলনের চেষ্টা করবেন তিনি। তবে এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি রাখাইনরা। সে কারণেই তাদের বিক্ষোভ আর উৎকণ্ঠা। তাদের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আমাদের রাখাইন দেশে বিদেশি প্রভাবে তদন্ত মানি না।’

দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) মিয়ানমারে সরকার গঠন করে। তবে সরকারে আসার পর তিনি রোহিঙ্গাদের দুরবস্থার বিষয়ে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকী নির্বাচন জিততে তিনি যে মুসলমানদের প্রার্থী করেননি, সে কথাও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। সবমিলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার শিকার হন সু চি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই ‘রাখাইন রাজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা কমিশন’ গঠন করার কথা জানান তিনি।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব বান কি-মুন মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টি কফি আনানের এই সফরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে কফি আনান মিয়ানমার পৌঁছালে শত শত মানুষ বিমানবন্দরের পথের দু’পাশে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে যায়, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি সেখানে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নন। রাস্তার দু’পাশে ব্যানার হাতে দাঁড়ানো জনগণ স্লোগান দেন, ‘কফির নেতৃত্বে কমিশন হবে না’।

উল্লেখ্য, জাতিগত গোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন এবং আলাদা হয়ে যাওয়া অধিকার দিয়ে ১৯৪৭-এর পাংলং চুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র এক বছর আগে চুক্তিটি করা হয়। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পরের বছর অং সান হত্যার শিকার হন এবং চুক্তিটি ভেস্তে যায়। সেই থেকে পরবর্তী সরকারগুলো পাংলং চুক্তিকে সম্মান দেখাতে পারেনি বলে অভিযোগ করে আসছে জাতিগত গোষ্ঠীগুলো। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পরই বিদ্রোহ শুরু করে কারেনরা। এরপর আস্তে আস্তে অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোও অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। বুধবার নতুন করে শুরু হওয়া শান্তি আলোচনায় কারেন, কোচিন, শান ও ওয়াসহ মিয়ানমারের ২০টি বিদ্রোহী জাতিগত গোষ্ঠীর ১৭টির প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পর অং সান সুচি অঙ্গীকার করেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবেন। পাঁচদিনের শান্তি আলোচনায় মিয়ানমার সরকার চায়, বিদ্রোহীরা অস্ত্র ছেড়ে দেবে। আর বিনিময়ে নতুন প্রাদেশিক ব্যবস্থায় জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে আরও ক্ষমতা দেবে সরকার।



মন্তব্য চালু নেই