জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্য দখলের পাঁয়তারা ট্রাম্পের!

ডোনাল্ড ট্রাম্প‘সভ্য পৃথিবী’কে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্ব থেকে ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’কে সমূলে উৎপাটনের আহ্বানের মধ্যদিয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মুসলিম বিদ্বেষী রূপরেখা স্পষ্ট করেছেন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বুশযুগের কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের মতোই ‘পবিত্রযুদ্ধ’ আর ‘বিধাতা’র প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছেন। এ কারণে প্রশাসনে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের বেশ কয়েকজন ইরাক-আফগান-ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় তিনি জারি করেন মুসলিমবিরোধী নিষেধাজ্ঞা। এরইমধ্যে ফাঁস হয়ে যায় মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধের খবর। সিআইএ প্রধানকে তুরস্ক সফরেও পাঠান ট্রাম্প। আর তার দেশের নেতৃত্বে সৌদি জোটের বিমান হামলাকে আরও নিরঙ্কুশ করে তোলে।

মঙ্গলবার সামরিক বাজেট ১০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। আর বুধবার কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে আবারও সরাসরি ইসলামি চরমপন্থীদের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। মুসলিম মিত্রদের নিয়ে ‘প্রধানতম শত্রু’ ইসলামিক স্টেট (আইএস) নির্মূলের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। আর পুরো সময়জুড়ে শাসিয়ে যেতে থাকেন তেহরানকে। জারি রাখেন ইমিগ্রেশন পলিটিক্স। অর্থাৎ মুসলিম নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি। অতীতের মার্কিন পররাষ্ট্রনৈতিক অবস্থান, ট্রাম্প প্রশাসনের নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভূমিকা ও তৎপরতা এবং হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেই বুশ যুগের মতো করেই ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে এনেছেন। আর এর বিপরীতে হুমকি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন মুসলমানদের। ভীতি ছড়াতে চাইছেন জনমনে। সবমিলে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’-এর নামে তিনি আদতে ইরাক-আফগান যুগে ফিরতে চাইছেন। চেষ্টা করছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ করার। ট্রাম্পের মুখ্য পরিকল্পনাকারী স্টিভ ব্যাননের কথাতেও ট্রাম্পের এই বাসনার সাক্ষ্য মিলেছে।

‘পবিত্র যুদ্ধ’-এর ডাক, ‘ঈশ্বর’ বন্দনা

শপথ গ্রহণের পর দেওয়া বক্তব্যেই ট্রাম্প তার মুসলিম বিদ্বেষের রূপ সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি ‘সভ্য পৃথিবী’কে ঐক্যবদ্ধ করে বিশ্ব থেকে ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’কে সমূলে উৎপাটন করার আহ্বান জানিয়েছেন। ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে দর্শকদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য দেখা গেলেও তা মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বুশ ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে ‘ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যে যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র রূপ নিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যের বাসনায়। ট্রাম্প অবশ্য ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। যুদ্ধের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন জানিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, “যখন আপনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মন খুলে দেবেন, তখন সেখানে বিদ্বেষের কোনও স্থান থাকে না। যেমনটা বাইবেলে বলা হয়, ‘যখন ঈশ্বরের মানুষেরা একত্রে বসবাস করে তখন তা হয় অত্যন্ত আরামদায়ক ও সুখকর’।” ট্রাম্প আরও বলেছেন, ‘আমাদের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মহান নারী-পুরুষদের দ্বারা আমরা সুরক্ষিত। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করছেন।’ এটা এক ‘পবিত্র যুদ্ধের’ ঘোষণা। এক ‘ধর্মযুদ্ধের’ অনুমোদন।

মুসলিমবিরোধী যুদ্ধনীতিতে কমতি ছিল না বুশ-ওবামা কারোরই। তবু তারা সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ প্রশ্নে সরাসরি ‘মুসলিম’ কিংবা ‘ইসলাম’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। ট্রাম্প পূর্বসুরিদের ধারাবাহিকতা ভেঙেছেন। কংগ্রেস অধিবেশনে সরাসরি ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি। প্রত্যয় জানিয়েছেন, আইএস নির্মূলের। মুসলিম মার্কিন মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে এই প্রত্যয় বাস্তবায়নের আশাবাদ জানিয়েছেন তারা।

ট্রাম্প প্রশাসনে ইরাক যুদ্ধের হোতারা

‘ইরাক যুদ্ধের কারণে প্রেসিডেন্ট বুশের ক্ষমতাচ্যূতির প্রশ্ন উঠলে আমি সায় দিতাম’—নিজের অতীত এই মন্তব্যের সমর্থনে ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারণায় বলেছিলেন, ‘ওই সময় মার্কিন প্রশাসন দেশকে ভুল পথে চালিত করেছিল। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে দাবি করে অভিযানের পরে দেখা গেল কিছুই নেই।’ তবে সরকার গঠন করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ঠিকই ইরাক-আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া নৌবাহিনীর কর্মকর্তা জেমস ম্যাটিসকে বেছে নিয়েছেন। ‘মানুষকে গুলি করাটা তেমন কোনও ব্যাপার না’—এমন মন্তব্য করে একবার ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন ম্যাটিস। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান কিথ কেলোগ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া যুদ্ধে বিশেষ কর্মকর্তা এবং ইরাক যুদ্ধে এয়ারবোর্ন ডিভিশনের চিফ অব স্টাফ হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ. আর. ম্যাকমাস্টার ১৯৯১ সালের প্রথম ইরাক যুদ্ধে (উপসাগরীয় যুদ্ধ) একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে ইরাকি রিপাবলিকান গার্ডের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করেছিলেন। ট্রাম্পের সব গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার নেপথ্যের মানুষ স্টিভ ব্যানন ভয়াবহভাবে যুদ্ধবাজ-বর্ণবাদী ও মুসলিমবিরোধী হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ব্যানন বলেছিলেন, ‘আমরা একটি যুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্যে আমরা স্পষ্টভাবেই এক বিশাল যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেডিওতে তিনি বলেন, ‘আপনার সামনে এক সম্প্রসারণবাদী ইসলাম এবং সম্প্রসারণবাদী চীন উপস্থিত। তারা অনুপ্রাণিত ও উদ্ধত। তারা এগিয়ে চলেছে। আর ভাবছে পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিস্টানরা পশ্চাদপসরণ করছে।’ ব্যানন ইসলামকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে উগ্রবাদী ধর্ম’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন। আর ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর মুসলিমবিরোধী যেসব নির্বাহী আদেশ দেওয়া হচ্ছে, তা ব্যাননের পরিকল্পনা অনুযায়ীই দেওয়া হয়েছে।

মুসলিম নিষেধাজ্ঞার ডাক

২৭ জানুয়ারি ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে পরবর্তী তিন মাসের জন্য সব ধরনের শরণার্থী কার্যক্রম বন্ধ করেন। এতে পরবর্তী তিন মাসের জন্য সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের (ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেন) নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আদালতের আদেশে ওই মুসলিম নিষেধাজ্ঞাটি স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর তা পুনর্বহালে নতুন নির্বাহী আদেশ জারির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এরপর বিশেষজ্ঞরা আভাস দেন, নতুন আদেশের এমন কিছু থাকার সুযোগ রয়েছে যার মধ্য দিয়ে আদালতের জটিলতা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। নতুন আদেশে দেওয়া ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় মুসলিমপ্রধান দেশের পাশাপাশি অমুসলিম দেশকেও অন্তর্ভূক্ত করা হতে পারে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন কিন্তু বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন এমন অভিবাসীদের বিতাড়িত করা হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। যদিও সর্বশেষ কংগ্রেস ভাষণে অভিবাসননীতি খানিকটা শিথিল করার ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। ইরাক নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া বৃহস্পতিবারের এক সাক্ষাৎকারে পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা বাড়ানোর সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ডিসেম্বরের এক টুইটার পোস্টেও তিনি একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। শুক্রবার কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে (সিপিএসি) বড় আকারের ‘সামরিকবান্ধব’ বাজেট পরিকল্পনা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। সিপিএসি-র সম্মেলনে ট্রাম্প ‘মার্কিন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সামরিক প্রতিষ্ঠা’র আভাস দিয়েছেন। পুরো নির্বাচনি প্রচারণাজুড়ে মধ্যপ্রাচ্যে ‘লাগামহীন’ অস্ত্র মজুদের তীব্র সমালোচনা করলেও ক্ষমতায় আসার পর ঠিকই ট্রাম্প ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও শক্তিশালী’ করে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এজন্য ট্রাম্পের পরিকল্পনায় রয়েছে ৭০টি নতুন যুদ্ধজাহাজ, সেই সঙ্গে তিনি ইরাক ও আফগানিস্তানে বুশ আমলের মতোই সেনাবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে সদা তৎপর। ট্রাম্প পারমাণবিক আধুনিকীকরণের জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ করেছেন। সিপিএসি কনফারেন্সে ট্রাম্প জানান, আক্রমণ ও আত্মরক্ষা- এই দুই ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর সামর্থ বাড়াতে বাজেট বৃদ্ধির জন্য তিনি কংগ্রেসে আহ্বান জানাবেন। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন সামরিক খাতকে আগের চেয়ে বড়, দক্ষ ও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে বলেও মনে করেন ট্রাম্প। ইরাক আফগান যুদ্ধের সময়ও ওই আত্মরক্ষার অজুহাত তোলা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সমরাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা খরচ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) জানাচ্ছে, ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে কার্যত মার্কিন সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। ২০১০ সালে ওবামা প্রশাসনের সময়ে এই সামরিক খরচ বেশ কিছুটা কমে আসলেও ২০১৫ সালে দেখা যায়, ৯/১১-এর আগের তুলনায় তা প্রায় ১৯০ শতাংশ বেশি।

সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে কি আসলে কোনও সমাধান আসবে? বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অ্যান্ড্রু বেসভিচ। ইরাক যুদ্ধে তার ছেলে প্রাণ হারান। মার্কিন সামরিক নীতির কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত বেসভিচ বলেন, ‘সামরিক খাতে যদি আর এক পয়সা বরাদ্দও না বাড়ানো হয়, তারপরও আমাদের বাজেট বরাদ্দই পৃথিবীর সব দেশের থেকে বেশি। আরও বৃদ্ধির কী দরকার? এর উত্তর যদি হয় জাতীয় নিরাপত্তা, তাহলে আবার আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়। তা হলো—কেন বছরের পর বছর যুদ্ধ অব্যাহত রেখেও কোনও আশানরূপ সমাধান আনতে পারল না যুক্তরাষ্ট্র? নিশ্চয়, এক্ষেত্রে আমরা খুব কম টাকা ব্যয় করিনি!’



মন্তব্য চালু নেই