জানেন? দেশে ৬০ ভাগ শিশুর জন্ম হয় সিজারে

স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ায় নয়, দেশে হাসপাতালে ৬০ ভাগ শিশুর জন্ম হয় সিজারের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৬ জনের জন্মই সিজারের মাধ্যমে। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশ শিশুর জন্মের সময় সিজারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বাড়তি আয়ের মনোভাবই বাংলাদেশে এই হার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির মূল কারণ। যেখানে সাধারণ মানের একটি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে একটি প্রসব করতে ১৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা নেয়া হয়, সেখানে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে এই চার্জ মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া মফস্বল পর্যায়ে গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ধরনের জটিল রোগী কোনো ধরনের চিকিৎসা হয় না বলেই এই আয় থেকে পুরো প্রতিষ্ঠানের খরচ চালানো হয়। একটি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রসূতি এবং চিকিৎসককে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সেক্ষেত্রে সিজারের মাধ্যমে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিটেই সন্তান প্রসব করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) রিপোর্ট ২০১৪ থেকে জানা গেছে, দেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ১০ জন শিশুর মধ্যে ৬ জন শিশুর জন্ম হয় সিজারের মাধ্যমে। আর বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে এ হার ৮০ শতাংশ। শিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবারের ক্ষেত্রে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে শতকরা ৭ শতাংশ এবং ধনী শ্রেণীর মধ্যে শতকরা ৫০ শতাংশ পরিবারে সিজারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হচ্ছে। বিডিএইচএস আরও জানায়, ২০০৪ সালে সিজারের মাধ্যমে ৪ শতাংশ শিশুর জন্ম হতো, ২০০৭ সালে ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ১৭ শতাংশ আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। আরও জানা গেছে, দেশের মোট ৬২টি ভাগ প্রসব এখনও বাড়িতেই হয়ে থাকে। ৩৭ ভাগ প্রসব হয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। এর মধ্যে ২২ ভাগ প্রসব সম্পন্ন হয় প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে এবং ১৩ ভাগ প্রসব হয় সরকারি হাসপাতালে এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, ঢাকার অনেক প্রাইভেট ক্লিনিক আছে সেখানে শতভাগ প্রসব সিজারের মাধ্যমেই হয়। তিনি জানান, তারকাবহুল প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে একটি সিজার করতে তিন থেকে চার লাখ টাকা লাগে। এর পরের ধাপে হাসপাতালে এ ব্যয় ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। সাধারণ মানের ক্লিনিকে এই ব্যয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।

গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান, মফস্বল পর্যায়ে গড়ে ওটা ক্লিনিক মালিকরা সিজারে আগ্রহী নয় এমন চিকিৎসকদের কাজ করার সুযোগ দেন না। আবার বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ সময় প্রসব ব্যথা নিয়ে অপেক্ষা করতে রাজি হন না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রসব শুরু হওয়ার ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রসূতির স্বজনরা অস্থির হয়ে ওঠেন। তাই সামগ্রিক প্রক্রিয়াই সিজারের পক্ষে। বিডিএইচএস থেকে জানা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পন্ন হওয়া প্রসবের মধ্যে সিজারের মাধ্যমে ৩৮ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এই হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শতকরা ৮০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। তবে এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এই হার ২৮ শতাংশ। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৫-তে দেখা যায়, দেশের উপজেলাগুলোতে সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্মের সংখ্যা প্রায় আটগুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে সন্তান প্রসবের জন্য মোট এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি মা ভর্তি হন। মোট প্রসবের মধ্যে ৪৭ হাজার ৮৬৮টি ছিল স্বাভাবিক প্রসব, আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় এক লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জন শিশুর। ২০১৪ সালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৪২ হাজার ৯৫২ এবং অস্ত্রোপচার হয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৪৩ জনের। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করা হবে কোন পরিস্থিতিতে।

গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষিত ও ধনী মানুষের মধ্যে সিজারের প্রবণতা বেশি। কিন্তু সিজারে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে প্রয়োজন হলে সেটা ধনী-দরিদ্র শ্রেণী বিভেদ সৃষ্টি করবে না। সবার জন্য তা সমান দরকার। প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারিকে বলা হয় জীবনরক্ষাকারী পন্থা-কারণ। প্রি-অ্যাকলামশিয়াসহ আরও কিছু বিষয় যখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সিজারের মাধ্যমে মা এবং সন্তানের জীবন রক্ষা করা হয়। এটা ছাড়া আরও কিছু মেডিকেল ইন্ডিকেশন রয়েছে যেগুলোর জন্য সিজার করতে হয়।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, এটা এক ধরনের চিকিৎসা অর্থনীতি। কারণ এটা একদিকে চিকিৎসকদের বাড়তি আয়ের অন্যতম খাত, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের আয়ের প্রধান উৎস। তিনি বলেন, একটি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। এ সময়ে রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়, যা একজন ডাক্তারের জন্য প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া স্বাভাবিক প্রসবে চিকিৎসকের নিজস্ব কোনো আয় থাকে না বললেই চলে। অন্যদিকে সিজার করতে সব মিলিয়ে সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। আর এটুকু সময়ে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত আয় হয় ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।



মন্তব্য চালু নেই