জামায়াত-বিএনপি সম্পর্কে ঝাঁকুনি!

মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে দীর্ঘ দিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই শক্তিশালী মিত্রের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝাঁকুনি পড়েছে রাজনৈতিক গাটছড়ায়।

সূত্র মতে, এরই মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে এই দ্বন্দ্বের বিচ্ছিন্ন বহি:প্রকাশ ঘটলেও রাজনৈতিক কারনে দল দুটির শীর্ষ নেতারা বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির কর্মকান্ডে জামায়াতের তৃনমূলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের অবস্থানকেই সঠিক বলেই মনে করছেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারে বিএনপির ‘নিশ্চুপ অবস্থান’ দল দুটির জমাট সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হবার নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

দেশের চলমান রাজনীতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যায় জামায়াত। স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে ওই জোট গঠন নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়লেও বিএনপির ক্ষমতায় ফিরতে তা কার্যকর ছিল বরে প্রমাণ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে কোণঠাসা করে দিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়েই ক্ষমতায় ফেরে চারদলীয় জোট। তখন মিত্রতার বন্ধন আরো অটুট হয়। এরপর থেকেই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপিকে ছায়ার মতো অনুসরন করেছে জামায়াত। জোটবদ্ধ হওয়ার একযুগেরও বেশি সময়ে ছোট ছোট ভুল বোঝাবুঝি হলেও বর্তমানে টানাপোড়েন চরম আকার ধারন করেছে। এর আগে দল দুটির সম্পর্কে এমন ঝাঁকুনি লাগেনি।

সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতি শুরু মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে বিএনপি প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকায় জামায়াত বরাবরই অসন্তুষ্ট। বিশেষ কওে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির পর বিএনপির নীরবতা রীতিমতো ক্ষুব্ধ করে তোলে দলটিকে।

এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অন্য জামায়াত নেতাদের ব্যাপারেও বিএনপির নীরব অবস্থান ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত। সর্বশেষ জামায়াতের ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত গোলাম আযমের মৃত্যুর পর বিএনপির কেউ তার মরদেহ দেখতে যাননি এবং জানাযায়ও অংশ নেননি বিএনপির কোনো নেতা। তাছাড়া শোক প্রকাশ না করা ও জানাজায় অংশ না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতের কাছে নানা যুক্তি তুলে ধরা হলেও জামায়াত বিষয়টিকে সহজভাবে নেয়নি। তার বহি:প্রকাশ ঘটেছে গোলাম আযম পুত্র আমান আযমীর স্ট্যাটাসে।

এছাড়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলী ও সহকারী সেক্রটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড হলেও বরাবরের মতো নিশ্চুপ রয়েছে বিএনপি। এ নিয়ে জামায়াতের তৃনমূলে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যার বিচ্ছিন্ন বহি:প্রকাশও ঘটে জামায়াত-শিবিরের আচরণে। তারা জোটের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেও বিএনপি জামায়াতকে কী দিয়েছে, সে প্রশ্ন তোলেন দলের কেউ কেউ।

এ সব ঘটনা আগেই জামায়াতের প্রাক্তন আমির প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীর ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে জামায়াত-বিএনপি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোলপাড় শুরু হয়। তিনি তার ফেসবুক একাউন্টে লেখেন, ‘জামায়াতের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি কখনো সরকার গঠন করতে পারেনা।’

তিনি আরো বলেন, ‘অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুতে গোটা বিশ্ব যখন শোকাহত, তখন বিএনপির নীরবতায় সমগ্র জাতি হতাশ হয়েছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির এবং আমৃত্যু আধ্যাত্মিক গুরুর মৃত্যুতে তাদের নীরবতা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য!’

যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আযমীর ওই বক্তব্য তার নিজস্ব মত হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আযমী সাহেব গোলাম আযমের পুত্র। তিনি জামায়াতের কেউ কিনা তা জানিনা। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে জোট তা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং বর্তমান দু:সময়কে সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের জোট।’

তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে জামায়াত কোনো মন্তব্য করেনি। তাই বিএনপি এটি আমলে নেবেনা। আমান আযমী ব্যক্তিগতভাবে এমন মন্তব্য করতেই পারেন।’

বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় নিয়ে বিএনপির নিশ্চুপ অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে সঠিক মনে করছেন দলের নেতারা। একের পর এক রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত যেমন কঠিন সংকটের মধ্যে আছে, তেমনি বিএনপিও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। একদিকে বিচারের পক্ষে ব্যাপক সমর্থনের বিষয়টি চিন্তা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে জোটের প্রধান শরিক জামায়াতের সংকটকালীন সময়ে পাশে দাঁড়াতে পারছেন না তারা। এ নিয়ে মনোকষ্টে থাকলেও জামায়াতের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো মন্তব্য করা হয়নি। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটছে।

তবে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের অবনতির বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘২০-দলীয় জোট যে লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে, সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। গণতন্ত্র পূনরুদ্ধার ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় জোটের ভুল-বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতির কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমদ আজম খান। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে বিএনপি তার অবস্থান আগেই জানিয়েছে। নতুন করে বলা কিছু নেই। দল মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচার চায়। তাছাড়া জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে জোট তা আদর্শিক নয়, নির্বাচনী।’

তিনি বলেন, তাই এ নিয়ে ভূল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। নিজামীর রায়ের পরও নাটোরে বিশাল জনসভা হয়েছে। সেখানে জামায়াত নেতারা উপস্থিত ছিলেন, বক্তব্য রেখেছেন। দুরত্ব তৈরি হওয়ার মতো কিছু এখনো ঘটেনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আদর্শিক জোট। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও এ বিষয়টি বারবার বলেছেন। দুটি দলই গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে। ওই আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি, সংগ্রামরত রয়েছে। তাই এখন এ প্রশ্নটি আসা উচিত নয়। যদি গণতন্ত্র উদ্ধার হতো, কোনো সংকট না থাকতো; তাহলে জামায়াত প্রশ্ন তুলতে পারতো। সেই সময় তো আসেনি।’

তিনি বলেন, মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে উচ্চ আদালত যে সব রায় দিয়েছে তা নিয়ে বিএনপির নতুন করে কিছুু বলার নেই। বিএনপিও আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছ বিচার প্রত্যাশা করে।



মন্তব্য চালু নেই