‘জীবন যুদ্ধে এক কঠিন বাস্তবতার শিকার ওরা’

-‘স্যার আমারে একটু ছুডি দেন। আমার পা ফুইল্লা গ্যাছে। আর হাঁটতে পারতাছি না। ওষুধ খাওন লাগবো। দুপুরের পর চইলা আসুমনে। আমারে একটু যাইতে দেন। মা যাইতে কইছে।’

-চলে গেলে তোর কাজগুলা করবে কে? তোর কাজ কি আমি পারবো? বিকেলে মাল ডেলিভারি। ওষুধ নিয়ে আসতে পারলি না? যা, কাজ শেষ কর। পরে যাইস।’

রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি ওয়ার্কশপের মালিক আর শিশুকর্মীর মধ্যে কথোপকথন। পাশের টঙ দোকানে চা পান করতে করতে দৃশ্যটা দেখলাম। সিনেমায় এমন দৃশ্য অনেকবার দেখেছি। বাস্তবেও হয়! এক ফাঁকে কথা বললাম ছেলেটার সঙ্গে। কিছু বলতেই চাইছিল না। নানান কথা বলার পর জানালো, ওর নাম জাহিদ। ওয়ার্কশপ মালিকের নাম মানিক মিয়া। অনেকদিন ধরেই কাজ করছে এই ওয়ার্কশপে। তিনদিন আগে কাজ করতে গিয়ে মাথার ওপর থেকে লোহার ভারি খণ্ড পড়ে বাম পায়ে ব্যথা পেয়েছে।

জাহিদ বললো, ‘ফুলা ঠ্যাঙ নিয়াই কাজ করি। মালিক ছুটি দেয় না। প্রতিদিন সকাল ৬টার সময় কাজে আসি। যাই রাত ৯টা। দিন-রাত কাম করি। মেশিন চালাই, লোহা-রড কাটি। বড় বড় আলমারি বানাই। সবাই এই কাম পারে না।’

শুধু জাহিদ নয়, তার মতো এমন শতশত শিশু কর্মরত রয়েছে অধিকাংশ কলকারখানায়। বিভিন্ন সময়ে কাজ করতে গিয়ে এসব শিশুশ্রমিক আঘাতপ্রাপ্ত হলেও চিকিৎসা পাচ্ছে না তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশু শ্রম জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ১৭ লাখের বেশি শিশু শ্রমিক রয়েছে। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী এ শিশুরা পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে। সব মিলিয়ে দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে।

জরিপে আরো দেখা গেছে, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে গ্রামীণ অঞ্চলে রয়েছে শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ২৪ লাখ ৭০ হাজার শিশু। শহরে এর সংখ্যা ৫ লাখ ৭০ হাজার। আর সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার শিশু। এ এর মধ্যে ২১ লাখ ছেলে শিশু ও ১৩ লাখ কন্যা শিশু রয়েছে।

পুরান ঢাকার অধিকাংশ কারখানা ঘুরে এসব শিশুকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল নানা অভিযোগ, কারখানাগুলোতে কর্মরত শিশুদের নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। সামান্য দোষেই কিল, থাপ্পড়, চড়, ঘুষি, লাঠি দিয়ে আঘাতসহ মারাত্মক আঘাত করা হয়।

মালিকরা সাধারণভাবে মনে করেন এ নির্যাতন তেমন ক্ষতিকর নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের আঘাত শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত শারীরিক আঘাত ও বকাঝকার ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। তারা অন্যসব শিশুর মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। কর্মজীবনে কর্মহীনা হয়ে উঠে তারা।

বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানমের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে এমন আচরণের ফলে পরবর্তী জীবনে তারা ভীত সন্ত্রস্ত আচরণ করে।সাভাবিক মানুষের মতো সমাজে তাদের আচরণ পরিলক্ষিত হয় না। কর্মজীবনেও তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্যাতিত হওয়ার পরও দুর্বল শিশুটি বাবা মা, শিশু অথবা গৃহকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। ফলে তার মনে জন্ম নেয় হিংস্রতা, ক্রোধ।

আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলওর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন প্রতি মিনিটে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একজন শিশু শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা আঘাতের শিকার হচ্ছে। বর্তমানে শিশু শ্রম প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও বিশ্বজুড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। যেসব কাজে শিশুর নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার।

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বিষাক্ত বা দেহের ক্ষয় সাধনকারী কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটায় তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। অন্যথায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ন্যূনতম ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি শুধু কথায় নয়, কাজে পরিণত করতে পারলেই শিশু নির্যাতন রোধ সম্ভব হবে।



মন্তব্য চালু নেই