জেলে জীবন : দস্যু ভয় তবুও খাইতে হইলে, যাইতে হয়

ভোলার চরফ্যাশনে উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে সাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলেদের দুর্দশার কোন অন্ত নেই। একদিকে উত্তল সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে জলদস্যুর উৎপাত। তারওপর রযেছে মহাজনের দাদনের নীপিড়ন।

প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে, বোটের (জেলে ট্রলারের) পাশে বোট লাগাইয়া অস্ত্র ঠেকাইয়া আউড়াচাউড়া (এলোপাথারি) মাইর শুরু করে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঝিকে নিয়ে যায় জলদস্যুরা।

আবার কোনো কোনো সময় মাঝির সঙ্গে যুবক বয়সী থাকলে তাদেরকেও নিয়ে যায়। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বাঁচার চেষ্টা করলে জীবন শেষ।

এমন কথাই বললেন ভোলার চরফ্যাশনের আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ শিবা গ্রামের জেলে আঃ রসিদ মাঝী,। ১৫/২০ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরছেন, তাই জলডাকাতের ভয় এখন তার গা সয়ে গেছে। আতঙ্ক রয়েছে জেনেও প্রতিনিয়ত জীবনের কঠিন ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তিনি।

জলদস্যুদের উৎপাতের কথা আক্ষেপ করে বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাদের। জলদস্যুদের নির্যাতনের কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে গেছেন উপকূলের জেলে পরিবারগুলো, এখন আর ভালো লাগে না তাদের। সবাই শুধু তাদের কথা শুনেই যায়, পায় না কোনো প্রকার প্রতিকার। তাই এখন বলতে কষ্ট হয় তাদের কষ্টগাথা জীবনের দুর্দশার কথাগুলো।

গভীর সমুদ্র্রে যখন জলডাকাত আক্রমণ করে, না থাকে কোস্টগার্ড না থাকে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী। তখন একমাত্র সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই খোলা থাকে না অসহায় জেলেদের। তবুও উপকূলের হাজার হাজার জেলেরা জলডাকাতের ভয় নিয়ে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে যাচ্ছে। কেউ ফিরছে আপন সংসারে, আবার কেউ কোনদিনই ফিরছে না এই ভব সংসারে।

আবার অনেকে জলদস্যুদের ভয়ে সমুদ্র সীমানা লঙ্গন করায় ভিনদেশের কারাগারে বন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছেন বছরের পর বছর মানবেতর জীবন। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের জেলে শাহেআলম মাঝী আওয়ার নিউজ বিডিকে বলেন, জানি জীবনের নিরাপত্তা নাই, হেরপর না যাইয়া উপায় নাই, পেটে ভাত দিতে হইলে যাইতেই হইবে গাঙ্গে (সাগরে)।

প্রত্যেক বছর ডাহাইতে পিডায় (পিটায়), মাইরা (মেরে) হালায় (ফালায়) হেরপরও গাঙ্গে যাই যদি মাছ পাই মাইয়া (মেয়ে) পোলা (ছেলে) লইয়া ভালো থাকতে পারুম হেই আশায়। সাগরে জলদস্যুদের অপরহণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জেলেরা। ইলিশ মৌসুমে সাগরে জলদস্যুতা চালিয়ে জেলে অপহরণ ও ট্রলার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে সাগর কেন্দ্রিক বিভিন্ন জলদস্যু বাহিনী।

আর মুক্তিপণের এসব টাকা আইন-শৃংখলা বাহীনির নাগালের মধ্যেই চলছে আদান-প্রদান। কর্তব্যরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরর নিক্রিয়তার কারণে জলদস্যুদের মুক্তিপণ বাণিজ্য অনেকটা নীরবেই মেনে নিয়েছেন জেলে, ট্রলার মালিক ও মৎস্যজীবীরা। উপজেলা ট্রলার মালিক সমিতি ও জেলে সমিতির হিসাবে গতবছর ৪০/৫০ ট্রলারসহ প্রায় শতাধিক জেলে অপহৃত হয়েছে।

শেষ সম্বল ভিটে মাটি বন্ধক রেখে জেলেপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ও ট্রলারপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুদের আস্তানা থেকে অপহৃতদের ফিরিয়ে এনেছেন স্বজনরা। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার ওপর কোন ভরসা নেই জেলেদের। তাই তো জলদস্যুদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে মুক্তিপণ পরিশোধ করে জেলেদের ফিরিয়ে আনাকেই নিরাপদ বোধ করেন স্বজনরা।

এ বিষয়ে চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শফিউল্লা পলোয়ান আওয়ার নিউজ বিডিকে জানান, জেলেদের তো উপায় নেই, খাইতে হইলে সাগরে যাইতে হবে, আর সাগরে গেলে জলদস্যুর কবলে পড়বে এটা এখন নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে উপকূলীয় জেলেরা।

এ নিয়ে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন সভা সমাবেশ করেও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি উপকূলীয় জেলেরা। পায়নি গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তার কোনো আশ্বাস। উপজেলা ফিশিং ট্রলার মালিক মো. ইউনুছ মিন্টু লাট আওয়ার নিউজ বিডিকে বলেন, বিরূপ আবহাওয়া, জলদস্যুদের উৎপাতসহ নানা প্রতিকূলতা সামাল দিয়ে ইলিশ শিকার করতে হয় জেলেদের। প্রতিবছর মৌসুম শুরুতে জেলেরা ইলিশ শিকারে গেলে জলদস্যুদের উৎপাত বাড়ে কয়েক গুণ। সাগরে মাছ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় জলদস্যুদের তান্ডব। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত জলদস্যু ভয়কে উপেক্ষা করে সাগরে যাচ্ছেন জেলেরা। দু‘বেলা দু‘মুঠো খেয়ে পরে বাঁচার জন্য।



মন্তব্য চালু নেই