জোয়ার এলেই ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠে স্কুলটিতে

বেলা পৌনে দুইটা। বৃহস্পতিবার। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি উচ্চবিদ্যালয়। দ্বিতীয় শিফটে (পালা) ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস চলছে। হঠাৎই ঢং ঢং করে বেজে উঠল ছুটির ঘণ্টা। আশপাশের নালা উপচে পানি তখন বিদ্যালয়ের সিঁড়ি ছুঁই ছুঁই। বারান্দা আগেই ডুবে গেছে। অথচ আকাশে মেঘ নেই, ছিল না বৃষ্টি। রোদের মধ্যে এই ছুটির কারণ সাগরের জোয়ারের পানি।

বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের দপ্তরি মাসে ছয় দিন এমন ‘অসময়ে’ ছুটির ঘণ্টা বাজান। গত মে মাস থেকে চলছে এ অবস্থা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, জোয়ারের পানিতে শ্রেণিকক্ষ ডুবে যাওয়ায় চার মাস ধরে প্রতি মাসের ছয় দিন এ সমস্যা হচ্ছে। এ বছর সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।

প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, তিন দিন ধরে সকালের পালার প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। মাধ্যমিক শাখার পাঠদান চলে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। কিন্তু জোয়ারের পানির কারণে গতকাল বেলা পৌনে দুইটায় ছুটি দিতে হয়েছে। ৭০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে গতকাল উপস্থিত ছিল মাত্র ১১৩ জন।

আগ্রাবাদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বাকলিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ভবনের একতলার শ্রেণিকক্ষেও টানা চার দিন ধরে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিতা সেন বলেন, জোয়ারের পানির কারণে বিদ্যালয় ভবনের একতলায় ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। ১ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থীর অনেকেই আসছে না। বিশেষ করে সকালের পালায় মেয়েদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বাকলিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলাও পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি ঠেলে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হচ্ছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র অন্বয় দে, মিনহাজ ও সাকিবুল। তারা বলে, পানির কারণে তাদের জুতা ও পোশাক নোংরা হয়ে গেছে। এই সময়টায় বিদ্যালয়ে যেতেও ইচ্ছা করে না তাদের।

জোয়ারজনিত এই জলাবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে নগর পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়ায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নগরের আশপাশের খালগুলোও প্রায় ভরাট। বর্ষাকালে স্বাভাবিকভাবেই পানির উচ্চতা বেশি থাকে। সে কারণে সমুদ্রের জোয়ার নদীতে আসার পর তা উপচে খাল-নালা দিয়ে নগরের নিচু এলাকা প্লাবিত করে। ফলে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জোয়ারের সময় বৃষ্টি না থাকলেও আগ্রাবাদ, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, বাকলিয়া, পাথরঘাটার মতো নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। রাস্তার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢোকে।

দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, জোয়ারের পানি ঢোকা বন্ধ করতে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে বাঁধ নির্মাণের জন্য মেয়রকে অনুরোধ করা হয়েছে। বাঁধ নির্মিত হলে শিক্ষার্থীদের এই সমস্যা থাকবে না।

জোয়ারের পানির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়ে আগ্রাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সালমা আখতার প্রতিবেদককে বলেন, আমার স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজার। কিন্তু জোয়ারের সময় পানি ভেঙে স্কুলে আসতে পারে না শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার থেকে স্কুল বন্ধ রেখেছি। প্রতি মাসেই সাত-আট দিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার আগে-পরে সব মিলিয়ে মাসের অর্ধেক সময় গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সিলেবাস শেষ করানোটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

বুধবার বেলা তিনটা। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর রোডসহ আশপাশের সব রাস্তায় জোয়ারে হাঁটুপানি। রিকশা না পেয়ে ওই পানিতেই হাঁটছে আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের ছাত্রী ফারজানা আকতার ও মাকসুদা আকতার। জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করায় বেলা আড়াইটার পরিবর্তে দুপুর সাড়ে ১২টায় কলেজ ছুটি হয়ে গেছে।

ফারজানা বলেন, জোয়ারের পানির মধ্য দিয়ে বাসায় ফেরার সময় প্রায়ই জামা-জুতা ভিজে নষ্ট হয়। এ সময় রিকশাও পাওয়া যায় না। পেলেও ২৫ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা দিতে চাইলেও যেতে চান না চালকেরা।

আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের পাশেই আগ্রাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। জোয়ারের পানির কারণে বিদ্যালয়টির মাঠ তখন হাঁটুপানিতে থই থই। শ্রেণিকক্ষে পানি ঢোকায় তিন দিন ধরে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বিদ্যালয়টিতে।

চার মাস ধরে জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতার কারণে আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, পাথরঘাটা, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইসহ চট্টগ্রাম নগরের বেশ কিছু এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। এর সঙ্গে বৃষ্টি যোগ হলে ভোগান্তি পৌঁছাচ্ছে চরমে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো দিন ক্লাস ও পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কম থাকে। সরেজমিনে এবং কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাওয়ার কথা জানালেন পাথরঘাটা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদুর রহমান চৌধুরী। মুঠোফোনে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বেলা একটা বাজলেই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ছুটির দরখাস্ত নিয়ে আসছে। আমরা ক্লাস বাতিল করিনি। কিন্তু মেয়েদের কলেজ থেকে ফেরার পথে কষ্ট হচ্ছে।

পাথরঘাটা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী ফারহানা বলেন, কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির জন্য কলেজে আসা-যাওয়া করতে খুব সমস্যা হচ্ছে।

অবশ্য জোয়ারের কারণে নগরের কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন।

মুঠোফোনে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা পুরো এলাকার মানবিক সমস্যা। আমার জানামতে, আগ্রাবাদের ছয়-সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানির জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া নগরের নিচু এলাকাগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সমন্বয় করে নিজেদের সুবিধামতো সূচি তৈরি করে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বলেছি।-প্রথমআলো



মন্তব্য চালু নেই