জ্বালানি তেলের দাম কমাতে কমিটি গঠনের ইঙ্গিত

জ্বালানি তেলের দাম কমাতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কমিটির সুপারিশক্রমে নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হতে পারে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার পরও দেশে দাম কমানো হয়নি। এতে দীর্ঘদিন জ্বালানি তেলে যে লোকসান দেওয়া হয়েছে, তা সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তারা এখন লালে লাল। দাম কমানোর বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাই তার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। বিপিসির কাছে এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে কিছু করণীয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী ও প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে একটি চিঠি দেন। এতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তিনি।

চিঠিতে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে আমাদের কিছু করণীয় আছে। মনে হচ্ছে যে, জ্বালানি তেলের দরপতনটি বেশ কিছুদিনের জন্য স্থায়ী হবে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, দরপতন হয়েছে ব্যাপক। আমাদের এ খাতে অনেক ভর্তুকি দিতে হয়েছে। সে কারণে তেল শোধনকারী প্রতিষ্ঠান অথবা জ্বালানি বিতরণ প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দুর্ভোগের মধ্যে ছিল। আমরা সব সময় নিয়মমতো ভর্তুকি দিইনি। তারাও নিয়মমতো কর-ভ্যাট ইত্যাদি আদায় করেনি। বর্তমানে এইসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো।

চিঠিতে বলা হয়েছে, এখন আমাদের বাজারদর নিয়ে চিন্তা করা যথোপযুক্ত হবে। আমরা এই মুহূর্তে মোটামুটি ১৪ লাখ টন ক্রুড অয়েল আমাদের রিফাইনারিতে রিফাইন করি। এতে যে বিভিন্ন পেট্রোলজাত পণ্য উৎপাদিত হয়, সেটাও আমাদের চাহিদার অতি সামান্য অংশ পূরণ করে। আমাদের চাহিদা অবশ্য দুটি পেট্রোলজাত পণ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি। সেগুলো হচ্ছে ডিজেল এবং ফার্নেস অয়েল। আমরা সম্ভবত বছরে ১ কোটি টন পেট্রোলজাত দ্রব্য ব্যবহার করি। তার সিংহভাগ আমদানি করি এবং বিভিন্ন সরকারি কোম্পানির মাধ্যমে বিতরণ করি। আগে সমুদয় ক্রুড অয়েল এবং পণ্যাদি একমাত্র সরকারই আমদানি করত। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ব্যক্তিমালিকানা খাতের প্রতিষ্ঠানও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানি করে। প্রথমেই বর্তমান হ-য-ব-র-ল অবস্থাকে বিশ্লেষণ করা দরকার। আমি জেনেছি যে, বিপিসি আমদানিকৃত পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদির দাম ৩০ ডলারে হিসাব করে। আমরা হিসাব করতাম ৮০ ডলারে এবং সম্ভবত ১১০ ডলারেও হিসাব করেছি।

অর্থমন্ত্রী তার চিঠিতে বলেন, আমাদের প্রথমেই ভাবতে হবে, আমরা পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের দাম কমাব কি না? বর্তমানে যে দামে পেট্রোল সরবরাহ করা হয়, তাতে সম্ভবত আমাদের হিসাব হলো- ১১০ ডলারে এক ব্যারেল। আমাদের দ্বিতীয় যে বিষয় নজর দিতে হবে তা হলো- আমরা ক্রুডের যে আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করব, সেটা যেন সব প্রতিষ্ঠানে একই রকম হয়। অর্থাৎ ইস্টার্ন রিফাইনারি, বিপিসি দুটি প্রতিষ্ঠানই যাতে একইভাবে হিসাব করে। তৃতীয় বিষয়টি হবে, আমরা এই মুহূর্তে বাজার দাম কত ঠিক করব। আমরা নিশ্চিত যে, বাজারদর কমালে আপাতত কোনো ভর্তুকির প্রয়োজন হবে না। তবে আমরা একেবারেই বাজারদর সঙ্গে আমাদের সরকার নির্দিষ্ট দাম একপর্যায়ে না-ও রাখতে পারি। ইতিমধ্যেই আমাদের এক সিদ্ধান্ত আছে যে, আমাদের বাজারদর আন্তর্জাতিক বাজার দামের ১০ শতাংশ কম-বেশি হতে পারে। সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করলে আমাদের পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের দাম বেশি কমাতে হবে।

অর্থমন্ত্রী মনে করেন, সমুদয় বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। এ জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, যে প্রথমেই জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের বর্তমান অবস্থা এবং দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহের বর্তমান অবস্থান নিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রণয়ন করবে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে এক সপ্তাহ লাগতে পারে। প্রতিবেদন প্রণয়নকালে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সেই প্রতিবেদনে তারা পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে সুপারিশ করবেন। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটিতে বিবেচনা করতে পারি। এখানে সব মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক কমিটিতে আছেন এবং যেসব মন্ত্রণালয় ক্রয় কমিটিতে আছেন তারা যৌথভাবে আমন্ত্রিত হতে পারেন।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বেশি চাহিদা যোগাযোগ, বিদ্যুৎ এবং কৃষি খাতে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট জ্বালানি তেলের ৪৬ শতাংশ চাহিদা রয়েছে। এর পরেই আছে বিদ্যুৎ খাত। যেখানে ২৫ শতাংশ তেলের ব্যবহার হয়। আর কৃষি উৎপাদনে প্রয়োজন পুরো চাহিদার ১৭ শতাংশ জ্বালানি তেল।

২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেলের দাম উঠেছিল ১২২ ডলার। সেই বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ওই বছর ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন পেট্রোল-অকটেনে লিটারপ্রতি ৫ টাকা ও ডিজেল-কেরোসিনের দাম ৭ টাকা করে বাড়ানো হয়েছিল। এরপর তেলের দাম কমতে কমতে ৩৮ ডলারে নেমে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসার প্রথম দিকে বলা হয়, বিপিসি এর আগে প্রচুর লোকসান দিয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিপিসির কাছে প্রচুর অর্থ পাওনা রয়েছে। আগে সেগুলো পরিশোধ করা হোক। তারপর দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামও কমতে থাকে। গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে থাকলেও বাংলাদেশে এখনো কমেনি। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে বছর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ১১০ ডলার, আর এখন তা নেমে এসেছে ২৭ থেকে ৩০ ডলারের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং তেল বিক্রি থেকে বিপিসির অবস্থা রমরমা।

বাংলাদেশে তেলের দাম না কমার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘তেলের দাম সরকারের নির্বাহী আদেশে বাড়ানো-কমানো হয়, এ বিষয়ে বিপিসির কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার বিষয়টি সরকার ওয়াকিবহাল আছে। সরকার তেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর জন্য যখন যেভাবে নির্দেশ দেবে, সেভাবেই কাজ করা হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদনকারী দেশগুলো সমস্যায় পড়েছে ঠিক, তবে বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো স্বস্তিতেই আছে। বিপিসি অতীতের সব লোকসান কাটিয়ে মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করেছে। সংস্থাটির ওই কর্মকর্তা বলেছেন, এই মুনাফা আগামীতে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবং এই মুনাফার অর্থ দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার কাছে থাকা দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে।

এদিকে জানা গেছে, প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেল ৪০ ডলারের বেশি দরে কেনার পরও প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে ২০ টাকা, পেট্রোলে ৩৫ টাকা আর অকটেনে ৪০ টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে তেল বিক্রি করে মুনাফা হয়েছে ৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। বিপিসি মনে করছে, চলতি বছরে উদ্বৃত্ত আরো একটু বেশি হবে। যদি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এরকমই থাকে, তাহলে উদ্বৃত্ত ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা থাকবে।-রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই