টেকনাফে ৪ দিনের টানা ভারীবর্ষণ : এক দ্বীপেই ৪০ হাজার মানুষ পানি বন্দি

সীমান্ত জনপদ টেকনাফে চার দিনের টানা ভারীবর্ষণে জন-জীবন ব্যাহত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি, বঙ্গোপসাগর ও নাফনদীর জোয়ারের পানিতে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার বসত-বাড়ি, সড়ক, মৎস্যঘের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্থ হয়ে উঠেছে। ঝড়ো হাওয়া কবলে পড়ে সেন্টমার্টিন ও শামলাপুরে ৪টি ফিশিং বোট ডুবির ঘটনা ঘটেছে।

এঘটনায় ১ জেলের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া টর্নেঢোর আঘাতে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনসহ উপজেলায় ৫০ টি বসতবাড়ী লন্ডভন্ড ও শুধু শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন জানমাল ও সম্পদ রক্ষায় জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য সর্তকতা জারী করেছে এবং ১৬ টি অতি ঝুঁকপূর্ণ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে ঝড়ো হাওয়ার কারনে গত ৪ দিন যাবৎ বিদূৎ বিহীন রয়েছে গোটা টেকনাফ উপজেলা।

ফলে ফ্রিজে রক্ষিত মাছ-তরকারীর পঁচন ধরেছে এবং গোটা উপজেলায় ভূতুড়ে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিগগিরই সরকারী উদ্যোগে পদক্ষেপ না নিলে রোগ-ব্যাধির সংক্রামনসহ পরিস্থিতি মারাতক আকার ধারন করতে পারে। উপজেলার উপকূলের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ শাহপরীরদ্বীপ ও সাবরাং ইউনিয়নের মানবিক বিপর্যয় ও করুণ দশার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও নিরাপদ সূপেয় পানির সংকট। বিশেষ করে শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই।

ওই এলাকার লোকজন কোন প্রকারে প্রতিবেশী গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। গত ৩ বছর ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। অতি বৃষ্টি ও বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানিতে গোটা শাহপরীরদ্বীপ একাকার। সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান জানান- প্রবল ঝড়ো বাতাসে ৮ টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ ও শাহপরীরদ্বীপের ৪০ হাজার মানুষ পানি বন্ধ হয়ে রয়েছে এবং জোয়ারের পানিতে ঘোলার পাড়া, জালিয়াপাড়া, মাঝের পাড়ার প্রায় ২শতাধিক বসত-বাড়ি প্লাবিত হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্থ জনসাধারণ পাশ্ববর্তী উঁচু গ্রামে আশ্রয় নিয়ে রাত যাপন করছে। বলতে গেলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। টেকনাফ পৌর এলাকার টেকনাফ কলেজসহ কলেজ পাড়া, জালিয়াপাড়ায় পানিতে প্রাইমারী স্কুল ও রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে। অলিয়াবাদের ফকিরার মোরায় পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে কাঁচা ঘর-বাড়ির ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বৃহত্তর নাইট্যংপাড়ায় পাহাড়ী ঢলে কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ এবং স্থানীয় গ্রামীণ সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় জনসাধারণের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড ডেইলপাড়ায় অসাধ্য ব্যক্তিরা একটি সরকারী কালভার্ট ও ড্রেন বন্ধ করে দেওয়াল নির্মাণ করায় ২শতাধিক পরিবারের পুরো গ্রাম পানি বন্ধি হয়ে পড়েছে বলে ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।

এছাড়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব গোদারবিল,হাবিরছড়া,মিঠাপানির ছড়ায় প্রবল ঝড়ো হাওয়া এবং পাহাড়ী ঢলে গ্রামীণ জনপদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অপরদিকে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম নয়াপাড়া,রঙ্গিখালী লামার পাড়া, উলুচামরী কোনারপাড়া, চৌধুরীপাড়া, নাটমোরাপাড়া, জালিয়াপাড়া, ফুলের ডেইল, সুলিশ পাড়া, হোয়াব্রাং, পশ্চিম সিকদারপাড়া,পূর্ব পানখালী, আলী আকবর পাড়া, মৌলভী বাজার, লামারপাড়ায় ভারীবর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে বসত-বাড়ি, মৎস্যঘের এবং রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে।

হ্নীলা ইউপি সচিব হাকিম উদ্দিন পাহাড়ী জানান, প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে অত্র ইউনিয়নের নিম্মাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, মৎস্যঘের ও বসত-বাড়ি প্লাবিত হয়েছে এবং ভূমি ধ্বসে প্রাণহানি এড়াতে ব্যাপক প্রচারনা চালিয়ে জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, নয়াবাজার, রইক্ষ্যং ও উলুবনিয়া এলাকায় পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে ৮০/৯০ ভাগ মৎস্যঘের ভেসে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বলে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী জানান। উপকূলীয় বাহারছড়ায় ৫নং হলবনিয়া গ্রামে সকালে প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় একটি বড় শিশু গাছ মাদ্রাসায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া শামলাপুর ও গুচ্ছগ্রামে প্রবল বাতালে প্রায় ২০ টি বাড়ী ঘর বিধ্বংস্থ হয়েছে।

বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মৌঃ হাবিব উল্লাহ জানান- প্রচারনা চালিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া গত ২৫ জুলাই বঙ্গোপসাগরে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে নুরুল হকের মালিকানাধীন একটি ফিশিং ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় আবদুল মজিদ নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯নং দক্ষিণ পাড়ায় টর্ণেডোর আঘাতে ৩০টি বাড়ি লন্ডভন্ড হয়েছে। আমির হামজা, নুর মোহাম্মদ ও সৈয়দ আলমের মালিকানাধীন ৩ টি ফিশিং বোটের ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এঘটনায় কেউ হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

সেন্টমার্টিনের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানান, টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। এ পর্যন্ত সরকারীভাবে কোন প্রকার সাহায্য বা ত্রাণ পৌঁছেনি। দ্বীপবাসী আতংকে দিনাতিপাত করছে। এছাড়া হ্নীলা রঙ্গিখালী মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল সংলগ্ন প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়া, পূর্ব পানখালীর কালভার্ট ভেঙ্গে যাওয়া এবং হোয়াব্রাংয়ের কালভার্ট ধ্বসে যাওয়ায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয়ভাবে ধারনা করা হচ্ছে পুরো উপজেলায় কোটি কোটি টাকার গ্রামীণ জনপদ, ব্রীজ-কালভার্ট, মৎস্যঘের ,বসত-বাড়ির ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এদিকে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোজাহিদ উদ্দিন উপজেলায় মাইকিং করে ভূমি ধ্বস ও ভারী বৃষ্টিপাত হতে জানমাল রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এই ধরনের দূর্যোগপূর্ণ পরিবেশ অব্যাহত থাকায় জনসাধারণের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।

এছাড়া টেকনাফে ভারী বর্ষণ,সতর্ক সংকেত, নদ-নদী ও সাগর উত্তাল থাকায় নৌকা ও ট্রলার দিয়ে মাঝি মাল্লারা মাছ শিকারে যেতে না পারায় বিভিন্ন মাছ বাজারে মাছের চরম আঁকাল দেখা দিয়েছে। নিত্যদিনের চািহদার তুলনায় মাছের বেঁচা-বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এদিকে টেকনাফ উপজেলায় কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বৃষ্টিতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

আবহাওয়া দপ্তর ও উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাও টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা করছেন। ইতিমধ্যে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা ইউএনও শাহ মোজাহিদ উদ্দিনের নির্দেশে শনিবার বিকালে উপজেলার ফকিরামোরা এলাকার পাহাড়ের অতি ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে থাকা ১৬টি পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে।

ইউএনও শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ফকিরামুরা, গিলাতলী, বৈদ্যেরঘোনা, নাজিরঘোনা, শিয়াইল্যারঘোনা, পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়া, কেরুনতলী, বরুইতলী, জাহালিয়াপাড়া, রোজারঘোনা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, লেচুয়াপ্রাং, পানখালী, সিকদারপাড়া, রোজারঘোনা, মিনাবাজার, রক্ষ্যইম, আমতলীসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে বাসিন্দাদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। যারা সরে যাবেনা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।



মন্তব্য চালু নেই