ডলফিনের সঙ্গে প্রেম

মাত্র ৬ বছর বয়সে প্রেমে পাগল হয় পিটার। ইংরেজির শিক্ষিকা মার্গারেট হো-র জন্য অচিরেই সঁপে দিয়েছিল দেহ-মন। তার অনুভূতিতে কী সাড়া দিয়েছিলেন যুবতী মার্গারেটও? সম্প্রতি তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে মানবী ও ডলফিনের অত্যাশ্চর্য প্রেমগাথা।

১৯৬৫ সাল। বছর ছয়েকের ‘বট্লনোজ’ ডলফিন পিটারকে নিয়ে এক অভিনব গবেষণার পরিকল্পনা করেন নাসার জীববিজ্ঞানী জন সি লিলি। আমেরিকার রোদ ঝলমলে সেন্ট টমাস অঞ্চলে তৈরি করা হয় ২২ ইঞ্চি গভীর কৃত্রিম জলাশয়। নোনা জলের এই পুল ঢাকা হয় স্বচ্ছ্ব আচ্ছাদনে। সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় একটি ডেস্ক এবং শাওয়ার কার্টেনে ঢাকা গদি। মনোযোগ কাড়তে এই প্লাস্টিক পর্দা মোড়া গদির উপরই জলের ঝাপটা মারত পিটার।

মানুষের ভাষা কী ভাবে রপ্ত করবে ডলফিন? ডলফিনের নাকের উপর রয়েছে একটি ব্লো হোল। শরীরের এই ছিদ্র দিয়ে হাওয়া ছুড়ে তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ বের করতে পারে তারা। ঠিক হয়, এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েই পিটারকে ভাষা শেখানো হবে। দশ সপ্তাহের এই পরীক্ষায় তাকে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় গবেষণা সহায়িকা মার্গারেট হো-কে। তরুণী মার্গারেটের সঙ্গে প্রথম দিন মোটেই ভালো ব্যবহার করেনি পিটার।

মানুষের ভাষা শেখার ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। শত চেষ্টা করেও প্রতি সকালে ছাত্রকে ‘হ্যালো মার্গারেট’ শব্দ দু’টি শেখাতে পারেননি হো। বদলে অন্য এক রকম আওয়াজ করে প্রতিদিন মার্গারেটকে স্বাগত জানাত পিটার। কিন্তু ধীরে ধীরে সদ্য যৌবনে পা-দেওয়া ছাত্রের ব্যবহারে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেন শিক্ষিকা। বুঝতে পারেন, ‘ভালো লাগা’ কবে যেন বদলে গিয়েছে ‘ভালবাসা’য়। তালিম শুরু হওয়ার চার সপ্তাহ পর ডায়েরিতে মার্গারেট লিখেছেন, ‘এ সপ্তাহে একাধিকবার পিটার যৌন আবেগের বশবর্তী হয়েছে।

বুঝতে পারছি, আমার প্রতি তার শারীরিক কামনা আমাদের সম্পর্কের মাঝে বাধা সৃষ্টি করছে। ও আমার দু পায়ের ফাঁকে এসে বার বার গুঁতো মারছে, আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে সাঁতার কাটছে, ঠোঁট দিয়ে আমায় ছোট ছোট টোক্কর মারার চেষ্টা করছে এবং আমায় নিয়ে এতই উত্তেজিত হয়ে উঠছে যে ওকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।’ কিন্তু পরিবর্তন কি শুধু পিটারেরই ঘটেছিল?মার্গারেট লিখেছেন, ‘কাজের খাতিরে পিটারের সঙ্গে সময় কাটানোর ব্যাপারটা কী ভাবে যেন প্রচণ্ড উপভোগ করতে শুরু করেছি।

আমাদের মধ্যে এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ওর সঙ্গে সারা দিন কাটানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। ওকে না দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।’ ডায়েরির শেষ পর্যায়ে ডলফিন নয়, বন্ধুকে ‘পিটার’ বলে ডাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন মার্গারেট। পিটারের শারীরিক চাহিদা যে তাঁর পক্ষে কোনও মতেই মেটানো সম্ভব নয়, তা বুঝে কৃত্রিম উপায়ে তার যৌন খিদে মেটাতে সাহায্য করেছেন। তবে তাঁর কথায়, সেটা শুধুই পড়াশোনার প্রতি পিটারের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে। কী রকম ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

মার্গারেট জানিয়েছেন, বড় দুর্লভ, বড়ই আলতো সেই অনুভব। পিটার জানত আমি ওর সঙ্গেই আছি। ও আমার চারপাশে থাকত। ওর চিন্তায় যা যৌনতা, আমার ভাবনায় তা সূক্ষ্ণ অনুভূতি ছাড়া কিছু নয়। এ যেন একটা ঘা, যা একটু চুলকে নিলেই ফের কাজকর্মে মন দেওয়া যাবে।’ দশ সপ্তাহ পর ইংরেজি শিক্ষার মেয়াদ ফুরোয়। পুলে মার্গারেটের যাতায়াতে ছেদ পড়ে। মনে মনে তিনিও হয়তো চেয়েছিলেন ডলফিন ও মানুষের আপাত অবাস্তব এই প্রেমে ইতি টানতে। কিন্তু সেই যুক্তি মানতে পারেনি পিটার।

গবেষণার শেষে সেন্ট টমাস থেকে জাহাজে তাকে মায়ামিতে লিলির গবেষণাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েক সপ্তাহ পর হঠাৎ মারা যায় পিটার। পশু চিকিতসক অ্যন্ডি উইলিয়ামসন জানান, ভগ্ন হৃদয়ই তার মৃত্যুর কারণ। অ্যান্ডির বয়ানে, ‘মার্গারেট যা বুঝতে পেরেছিলেন, তা মেনে নিতে পারেনি পিটার।

সে শুধু এটুকু টের পেয়েছিল যে তার ভালবাসার জনকে চিরদিনের মতো হারিয়েছে। তাই শেষে আত্মহত্যার পথই বেছে নেয় পিটার।’ ষাটের দশকের এই অভাবনীয় ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছে বিবিসি। পিটারের কথা বলতে গিয়ে রোমন্থনরত বৃদ্ধা মার্গারেটের চোখের কোণ কি চিক চিক করে উঠেছিল? এ সম্পর্কে অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি ছবির পরিচালক



মন্তব্য চালু নেই