আন্তর্জাতিক কল বাণিজ্যে নৈরাজ্য-২

ডিমপাড়ে হাসে, খায় বাগডাশে

আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের নতুন নিয়মে রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটররা। অবৈধ কল ঠেকানোর যুক্তি দেখিয়ে এ খাতের ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব মেনে গত ২৪ জুন থেকে নতুন নিয়ম চালু করে বিটিআরসি। এতে প্রভাব পড়ে উল্টো। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কল ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নির্দিষ্ট সাত অপারেটরের কাছে, কমে আয়ও।

মন্ত্রণালয় নতুন এ নিয়ম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুমতি দেয়ার পর পরই সাত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রতিষ্ঠা করে কমন ইন্টারন্যাশনাল পয়েন্ট (সিআইপি)। এর মাধ্যমে অন্য অপারেটরদের কাছে কল পৌঁছায়। এরপর তা গ্রাহকদের ফোনে যায়। এতে পুরো আন্তর্জাতিক কলের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাত আইজিডব্লিউ কোম্পানির কাছে। এ নিয়ম চালু হওয়ার দিনেই বৈধ কলের সংখ্যা ১২ কোটি মিনিট থেকে কমে সাড়ে ১০ কোটি মিনিটে নেমে আসে।

বিটিআরসির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের মালিকানাতে থাকা আইজিডব্লিউগুলোই এ সুযোগ নিয়েছে। তাদের চাপেই বিটিআরসি এই বৈষম্যমূলক পদ্ধতিতে সম্মতি দিয়েছে। সুবিধাভোগী সাত আইজিডব্লিউ হলো- ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশনস, রুটস কমিউনিকেশনস, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। এরা অপারেটর সুইচ (আইওএস) নামে পরিচিত। এ সময় সব আইজিডব্লিউ মিলে গঠন করে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ)।

কলরেট দেড় সেন্টের সঙ্গে আইওএস পদ্ধতি কার্যকর হওয়ার পর গত বছরের ২৪ জুন থেকে ২৩ আগস্ট এর কল টার্মিনেশন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ সময়ে দিনে গড়ে আন্তর্জাতিক কল এসেছে ১০ কোটি ৯৮ লাখ। মোট আয় হয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা । এর মধ্যে বিটিআরসির আয় দৈনিক ৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অপারেটরদের আয় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা । এ সময় আইজিডব্লিউ আয় হয় দিনে ২ কোটি ৫৫ লাখ, ভিএসপি ৬৪ লাখ, আইসিএক্স ২ কোটি ২৩ লাখ ও মোবাইলফোন অপারেটর ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা । এ ধাপে সবার আয় গড়ে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আইওএস পদ্ধতি চালুর দুই মাস পর কলরেটে পরিবর্তন আনে আইজিডব্লিউ ফোরাম, যা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়নি। বিটিআরসি সুত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যখন প্রতি মিনিটের সর্বনিম্ন রেট (ফ্লোর রেট) দেড় সেন্ট করা হয় তখন সর্বোচ্চ রেটের (সিলিং রেট) কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। এ সুযোগটি নেয় আইওএফ। তারা সরকারকে না জানিয়েই গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট দেড় সেন্ট থেকে বৃদ্ধি করে দুই সেন্ট করে। কল রেট বাড়ানো হলেও সরকার, মোবাইল অপারেটর, আইসিএক্স ও ভিএসপিদের জন্য দেড় সেন্ট দাম ধরেই রাজস্ব ভাগাভাগি হয়। ফলে বর্ধিত দশমিক ৫০ সেন্ট টার্মিনেশন রেটের হারে বাড়তি রাজস্বের পুরোটাই যাচ্ছে আইজিডব্লিউ অপারেটরদের পকেটে।

২০১৫ এর ২৪ আগস্ট থেকে ২০১৬ এর ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক কলের চিত্র বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টি ফুটে ওঠে। এ সময় দিনে কলের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ৪৯ লাখ। যা আগের ধাপের চেয়ে (২৪ জুন থেকে ২৩ আগস্ট ) ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম। এদিকে মোট রাজস্ব আয় বেড়ে হয় ১৩ কোটি ১৬ লাখ (৩ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছে)।

মজার বিষয় হলো মোট রাজস্ব বাড়লেও আইজিডব্লিউ ছাড়া বিটিআরসিসহ সকল অপারেটরের আয় কমেছে। বিটিআরসির দৈনিক আয় দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা (২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ কমেছে)। অপারেটরদের দিনে আয় বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা (২৭.১৫ শতাংশ বেড়েছে)। তবে অপারেটরদের মধ্যে শুধু আইজিডব্লিউ এর আয় বেড়ে হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বাকিদের আয় কমে হয়েছে ভিএসপি ৪৯ লাখ, আইসিএক্স ১ কোটি ৭৩ লাখ, মোবাইলফোন অপারেটর ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ রেট বাড়ানোর পুরো ফলটাই পাচ্ছে আইজিডব্লিউ।

বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস (যার সময়ে বহুল আলোচিত আইওএফ ও আইওএস এর অনুমোদন দেয়া হয়, যাতে সরকারের আয় কমে আর আইজিডব্লিউ আয় বাড়ে) এ বিষয়ে বিদায় নেয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিষয়টি স্থায়ী নয়। সরকারকেই এর সমাধান করতে হবে।’

এ পরিস্থিতিতে বিটিআরসি আন্তর্জাতিক কলরেটের সর্বোচ্চ সীমা দুই সেন্ট নির্ধারণ ও রাজস্ব ভাগাভাগির পরিমাণ নতুন করে সমন্বয় করে নীতিমালা সংশোধনের একটি প্রস্তাব ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

টেলিযোগাযোগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয় প্রস্তবানাটিকে আরও শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক কলের রাজস্ব ভাগাভাগির সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করেছে। এরপর এটি অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই নতুন নীতিমালা কার্যকর করা হবে।



মন্তব্য চালু নেই