তিন পায়ের হাতিকে চতুর্থ পা দিলেন ডাক্তার

‘হাতিমির দশা দেখো, তিমি ভাবে জলে যাই, হাতি বলে, এই বেলা জঙ্গলে চলো ভাই৷’ সুকুমার রায় ভেবেছিলেন সেই বিরলতম দৃশ্য৷ এক আশ্চর্য সঙ্কারায়ণের পর হাতির নিচের অংশ বদলে হয়ে গেল তিমি৷ সবটা মিলিয়ে হাতিমি৷ তবে কি না সেটা হলো গিয়ে কল্পনার ছড়া৷ আর এ হলো বাস্তব৷ এখানেও হাতির নিচের অংশে কাটাকুটি হলো, তবে হাতি কিন্তু হাতিই রইল৷ তিমি বা অন্য কিছু হয়ে উঠতে হলো না৷

মোতালা বা মোশা (নাম নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে) তার একটা ‘সাজানো পা’ নিয়ে দিব্যি হেসেখেলে বেড়ায়, দর্শকদের মনোরঞ্জন করে, মনের সুখে গাছ-পাতা খায় আর হ্যাঁ, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে শুভবোধের প্রেরণা ‘চার’ পায়ে হেলেদুলে চলে৷ মোশা আসলে হাতি, নিবাস তার থাইল্যান্ডে৷

কিন্তু হাতি তো চার পায়েই হাঁটবে, এতে আশ্চর্য কী? না, মোশা চার পায়ে চলত না, মানে চলতে পারত না৷ তার তিনটা পা সুস্হ ছিল, আর একটা পা-কে পা বলা যেত কি না সন্দেহ৷ মোশার যে পা নিয়ে কথা বলছি, সেটা সামনের বাঁদিকের পা৷ ১৯৯৯-এর আগে অবধি সে সুস্হ ছিল একদম৷ বয়স তখন তার সাত মাস মাত্র৷ তখনই ঘটল দুর্ঘটনা৷

সে বছর আপনমনে চলতে চলতে একটা ল্যান্ডমাইনের ছিটকে আসা টুকরোর ওপর পা পড়ে যাওয়ার পর থেকেই মোশার সুখের দিন শেষ৷ মোশা আবার যে সে হাতি ছিল না৷ সে ছিল কাজের হাতি৷ সরকারের বা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব ছিল তার ওপর৷ পড়ে যাওয়া, বা কেটে ফেলা গাছ বয়ে নিয়ে যেতে হতো তাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়৷ সেই হাতির পা গেল৷ ল্যান্ডমাইনের বিচ্ছিন্ন অংশই তার একটা পা নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল৷ মোশার মালিক অবশ্য তার দুর্ঘটনাগ্রস্ত পা-টাকে সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন যথেষ্ট৷ কিন্তু সব বৃথা৷ মোশার পা-টা পুরোপুরি খোঁড়া হয়ে গেল৷ তিন পায়ে বেচারাকে খুঁড়িয়ে আর লাফিয়ে চলতে হতো বেশ কিছুকাল৷ যদিও প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো ত্রুটি ছিল না, তবু বেচারার কষ্ট ছিল বড্ড৷

কী ভাবছেন? মোশার জীবন শেষ! একদম না৷ সেই হাতির পাশে এসে দাঁড়াল স্বয়ং সরকার, থাইল্যান্ড সরকার৷ সে দেশেই রয়েছে বিশ্বের প্রথম হাতির হাসপাতাল৷ থাইল্যান্ডে হাতি বলতে গেলে সমাজব্যবস্হার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ৷ কিছু আছে কাজের হাতি, বাকিরা পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য৷ থাইল্যান্ডের বিশেষ হাতি-পার্কে হাতিরা নানা রকম শো দেখায়৷ আবার থাইল্যান্ডের পথঘাটেও মাঝেমধ্যে মাহুত আর তার হাতির দেখা মেলাটাও বিচিত্র নয়৷ থাইল্যান্ডে হাতি অপ্রতুল নয়৷ কিন্তু অসুস্হ মোশাকে ‘বাতিল’ করে দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ৷ তা মোশার পাশে সরকার দাঁড়িয়ে কী করল জানেন?

উত্তর থাইল্যান্ডের ল্যামপ্যাঙের মাইইয়াও নামের হাতি হাসপাতালে ভর্তি করল৷ বছরটা ২০০৬৷ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া তার পায়ের চিকিৎসা শুরু হরো৷ পায়ের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল আগেই৷ এবার সে জায়গায় লাগানো হলো এক কৃত্রিম পা৷ স্হায়ী নয়, অল্প ক’দিনের আয়ু তার৷ সে নিয়ে কিছুদিন চলল মোশার জীবন৷ তবে সে পা যে বরাবরের জন্য টিকবে না, তা আগেই জানা ছিল৷ অভিজ্ঞ নির্মাতারা ততদিনে তার জন্য তৈরি করে ফেলেছেন আরও শক্তপোক্ত গড়নের নতুন এক পা৷ সেটাই প্রথম ‘প্রসথেটিক লেগ’৷ ফের পা প্রতিস্হাপন হলো মোশার, সাল ২০০৯৷ এই অপারেশনটা করলেন থাইল্যান্ডের নামী প্রসথেটিক সার্জন ডা. তার্ডচাই জিভাকেট৷ বিশ্বে এমন অভুতপূর্ব ঘটনা বিরলতম বললেও কম বলা হয়৷

তবে একবার কৃত্রিম পা লাগিয়েই কাজ শেষ নয় মোটেও৷ হাতির যেমন ওজন বাড়ে, সেই মতো তার জন্য নতুন পা তৈরি হয়, প্রতিস্হাপিত হয়৷ সম্প্রতি মোশা বহাল রয়েছে তার তিন নম্বর কৃত্রিম পা নিয়ে, যা বসানো হলো এ বছরেরই শুরুর দিকে৷ এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও যথেষ্ট সুস্হ জীবনযাপন তার৷ হেঁটেচলে বেড়ানোতেও কোনো অসুবিধে নেই৷ তাকে দেখতে এখন পর্যটকদের ঢল লেগেই রয়েছে৷ বনের পশুর পাশে কোন পর্যায়ের সহমর্মিতা নিয়ে মানুষ এসে দাঁড়াতে পারেন, বিশ্বে তার উজ্জ্বল নিদর্শন নিশ্চয়ই মোশার ঘটনা৷- ওয়েবসাইট।



মন্তব্য চালু নেই