তিন যুগ পর পথহারা ছাত্রদল

প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরে এসে এখন অনেকটাই পথহারা নাবিকের মতো উদভ্রান্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির ‘ভ্যানগার্ড’ খ্যাত এ সংগঠনটি এখন প্রায় অক্ষম ও নিস্ক্রিয়। দুই দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনুপস্থিতি, চরম অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দায়িত্বশীলদের পারস্পরিক অনাস্থা, বিভক্তি, ত্যাগী নেতাদের দলে জায়গা না হওয়া, সর্বোপরি দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় ভেঙে পড়েছে এর সাংগঠনিক শক্তি।

তবে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, সাময়িকভাবে আদর্শের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হলেও সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারলে এবং যোগ্যদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে পুরনো রূপে ফিরবে ছাত্রদল। সেজন্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিসহ সার্বিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।

১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গঠন করেন। ’৮০ এর দশকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদে ছিল ছাত্রদলের জয়জয়কার। তবে বর্তমানে সংগঠনটি অনেকটাই ম্লান।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপির আন্দোলনে ‘কার্যকর ভূমিকা’ পালন পারেনি ছাত্রদল। এজন্য তৎকালীন নেতৃত্বকে দায়ী করে নতুন নেতৃত্ব দেওয়ার জোর দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার আগে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে গত ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও মো. আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের নতুন কমিটি অনুমোদন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

২০১ সদস্যবিশিষ্ট ওই আংশিক কমিটির মধ্যে সহ-সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্পাদকম-লী মিলিয়ে ১৫৩ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোর কমিটিও আলোর মুখ দেখেনি।

ছাত্রদলের আংশিক কমিটিতে ৩৪ জনকে সহ-সভাপতি, ৩৫ জনকে যুগ্ম সম্পাদক, ২৭ জনকে সহ-সাধারণ সম্পাদক, ২৮ জনকে সহ-সাংগঠনিক ও ২৬ জনকে সম্পাদকম-লীর বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয়েছিল।

আংশিক কমিটি ঘোষণার পরপরই কমিটিতে জায়গা না পাওয়া নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ বিদ্রোহ করে। যোগ্য ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি করা হয়নি, এমন অভিযোগে তারা বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ এনে ওই দুই নেতার কুশপুতুলু পোড়ায় তারা। কমিটিতে জায়গা পাওয়া আর না পাওয়াদের দুটি গ্রুপের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষেও জড়ায়। তবে পদবঞ্চিতদের ছাত্রদলের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বিএনপির হাইকমান্ডের এমন আশ্বাসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর গত বছর নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও অন্য শাখাগুলোতে কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। এখন এসব শাখায় কমিটি নেই। জেলা কমিটিগুলোর মেয়াদও শেষ হয়েছে অনেক আগে। বছর সাতেক ধরে জেলায় কমিটি করা হচ্ছে না। ফলে মাঠপর্যায়ে সংগঠন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য ছাত্রদলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, সংগঠনের সভাপতি রাজীব আহসান গত ১৯ জুলাই পটুয়াখালীতে গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকায় কমিটি গঠনে সময় লাগছে। বিগত দিনের কমিটির এসব দায় নিয়ে তারাও রয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জর মুখে। কাকে বাদ দিয়ে কাকে কমিটিতে রাখা হবে, তা নিয়েও রয়েছে নানা মত, নানা সিদ্ধান্ত। এরপরও সিনিয়র-জুনিয়রদের সমন্বয় করেই কমিঠি গঠনের প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রদলে রাজনৈতিক কার্যক্রমও প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রেস রিলিজের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ছে এক সময়ের প্রভাবশালী এই সংগঠন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চাইলেও অনুমতি না পাওয়ায় তা করতে পারেনি সংগঠনটি।

সংগঠনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে ছাত্রদল সবসময়ই সক্রিয় ছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরের আন্দোলনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ‘আগ্রাসী ভূমিকা’র কারণে হয়তো প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি ছাত্রদল, কিন্তু রাজপথে ঠিকই আন্দোলন করেছে।

তিনি বলেন, এখন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রদল ঠিকই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে ছাত্রদল কাজ করছে বলেও জানান সংগঠনটির এই নেতা।

জানা গেছে, দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। এক যুগ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটি ঘোষণা করা হলেও তা এখনও পুনর্বিন্যাস করা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা এই অবস্থার জন্য সরকারের মামলা-হামলা ও হয়রানিকে দায়ী করছেন।

সংগঠন সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর কমিটিকে ভেঙে দুটির স্থলে চারটি করা হচ্ছে। বিএনপির ভবিষ্যৎ আন্দোলন সফলে নগরকে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম এই চারভাগে ভাগ করে কমিটি দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে মহানগর উত্তর ভেঙে উত্তর ও পূর্ব এবং দক্ষিণ ভেঙে দক্ষিণ ও পশ্চিম করা হয়েছে। ছাত্রদলে বিরাজমান সব গ্রুপকে অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে কমিটির কলেবর বড় হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বিদ্রোহীদের অনেককে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজসহ মহানগরের কলেজগুলোতে যাদের দিয়ে কমিটি করার কথা শোনা যাচ্ছে, আন্দোলন সংগ্রামে তাদের ভূমিকা ছিল না। ত্যাগী ও যোগ্যদের পরিবর্তে কমিটি ‘বিক্রি করা হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ তোলেন তারা।

তবে সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ছাত্রদলকে পুনর্গঠন এবং বহুধাবিভক্ত নেতাদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করাই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পরে সংগঠনটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সংগঠনের বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান বলেন, চলার পথে শত ঘাত-প্রতিঘাতের পরে ছাত্রদল এখন খাঁটি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞ একটি সংগঠনের রূপ নিয়েছে সংগঠনটি। ছাত্রদল চেষ্টা করছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংগঠনিক পুনর্গঠনসহ সার্বিক কার্যক্রমে গতি আনতে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রদলের আংশিক কমিটি পুর্ণাঙ্গ করা হবে বলেও জানান তিনি।-রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই