‘তুই খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিস…একা মেয়েদের এটাই হয়’

সাত সকালে অচেনা নাম্বারের ফোন। বিরক্ত হলেও ধরে ফেললাম।

“হ্যালো দেবশ্রুতি?”

“বলছি। কে বলছেন?”

“বাবা ! আপনি আজ্ঞে যে একেবারে!”

মনে মনে ভাবলাম, ফোনের ওপারে মানুষটা কে না বুঝেই ফট করে তুই তোকারি শুরু করলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে!

“আমি আসলে ঠিক…”

“চিনতে পারিসনি তা হলে? নীলাঞ্জনা রে।”

এই রে! আবার বিপদ। আমি অন্তত ৮/৯ জন নীলাঞ্জনা -কে চিনি। কিন্তু সেটা এনা-কে বলা যাবে না। যে রকম যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখছি!

“চুপ করে আছিস মানে এখনও চিনতে পারিসনি, প্রেসিডেন্সি, ইংলিশ, তোর ব্যাচ…”

” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। কী কাণ্ড! কতদিন পরে!”

“যাক্। বাঁচালি!”

“কিন্তু আমার নম্বর পেলি কোথা থেকে? কতদিন বাদে কথা হচ্ছে বল তো? বছর ১৫/১৬ তো হবেই, না কি?”

“অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে পেয়েছি ম্যাডাম।”

“সে তো বুঝতেই পারছি, তোর আর আমার বন্ধু সার্কেল তো একদম আলাদা। এত বছর যোগাযোগ নেই তার ওপরে।”

“হ্যাঁ ওই ফেসবুক থেকে তোর বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে, একে তাকে মেসেজ করে সে এক লম্বাআআ- ব্যাপার। এতটা ঝামেলা করতে হতো না তুই ফেসবুকে থাকলে।” বেশ বিরক্ত আমার বন্ধু।

ঢোঁক গিলি। হ্যাঁ আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় আর নেই বটে তবে তাতে বিশ্ব চরাচরের কোনও অসুবিধা হয়েছে বলে তো রিপোর্ট পাইনি…

“আবার চুপ করে গেলি? তুই কোথায় এখন? কলকাতায়?”

“কেন বল তো?”

“সবেতে কেন কেন করিস না তো, সাত সকালে বিরক্ত লাগে এত প্রশ্ন শুনতে।”

হক কথা। আমি আবার চুপ।

“আচ্ছা শোন, তোর শান্তিনিকেতনে বাড়ি আছে না একটা?”

এ বার আমার মাথা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করেছে।

সামনে দোল, শান্তিনিকেতনে থাকার জায়গার প্রবল আকাল। অগত্যা দু’ যুগ কোনও যোগাযোগ না থাকা বন্ধুকে খুঁজে বার করে ফোনাঘাত।

“আছে। কিন্তু তুই জানলি কী করে? ”

আমার অবাক হওয়া শেষ হয় না।

“তোর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকাকালীন ছবি দিয়েছিলি বোধহয়, সেটা সন্দীপ শেয়ার করেছিল ওর ওয়াল-এ– ‘How Green is this Valley’ বলে, তখনই নোটিস করেছিলাম।”

“বাপস রে! তুই তো গোয়েন্দা হলে নাম করতি!”

” হা হা। যা বলেছিস! এ বার আসলে এত দেরিতে বসন্তোৎসবে যাওয়াটা ফাইনালাইজ হলো যে কোথাও বুকিং পাচ্ছি না। আর তখনই তোর বাড়িটার কথা মনে পড়ে গেল। শ্রীমন্তীরও বাড়ি আছে ওখানে কিন্তু এ বার ওর ননদরা যাচ্ছে দোলে।”

“বুঝলাম, কিন্তু আমার বাড়ি তো ফাঁকা নেই রে। মা থাকেন ওখানে। আমিও বেশির ভাগ সময়টা ওখানেই থাকি আজকাল। ”

“আরে, তোর বাড়িতে নিশ্চয়ই একটা ঘর নয়। এত বড় বাড়ি, ছবি দেখেছি তো। আমাদের জাস্ট একটা ঘর ছেড়ে দিলেই হবে। দু’তিনটে দিনের তো মামলা।”

আমি আবার থমকাই।

“না রে, মা’র শরীরটা একেবারেই ভাল না। হাঁটাচলায় সমস্যা হয় বছর তিনেক আগে খুব বাজে একটা অ্যাকসিডেন্ট-এর পর থেকে। বাড়িতে অচেনা লোক থাকলে খুব অসুবিধে…”

মার শরীর সম্বন্ধে একটা প্রশ্নও না করে আমার বন্ধু তড়বড়িয়ে ওঠে, “আরে কাকীমার কোনও সমস্যাই হবে না। আমরা সেই সকালে বেরবো আর গভীর রাতে ঢুকব।”

শুনেই শিউরে উঠি। মার ৯ টার মধ্যে শুয়ে পড়া অভ্যেস।

নীলাঞ্জনা ফোনের ও প্রান্তে দেখতে পাচ্ছে না জেনেও জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, ” না রে একেবারেই সম্ভব নয় সেটা আমার সংসারের সেট আপ-এ। প্লিজ কিছু মনে করিস না।”

“তোর আবার সংসার কী! আজ এখানে কাল সেখানে। যাযাবরের জীবন। একটা অতবড় বাড়িতে কাকীমা একা থাকেন,আমরা গেলে বরং দেখবি কাকীমার ভাল লাগবে।”

ওর জীবন বোধে অবাক হয়ে আমি চুপ।

নীলাঞ্জনা খোঁচা মারে, ” কীরে!”

সম্বিত ফিরে আমি বলে উঠি, “আমার এ বার বেরোতে হবে রে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ছিক করে শব্দ করে নীলঞ্জনা বলে, “তুই খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিস দেবশ্রুতি। একা মেয়েদের এটাই হয়।”

এতক্ষণ বাদে জোরে হেসে উঠি। “তার মানে তুই বলছিস একা পুরুষ, বিবাহিত মহিলা ও বিবাহিত পুরুষেরা স্বার্থপর হয় না?”

“তাত্ত্বিক আলোচনার দিকে ব্যাপারটা টেনে নিয়ে যাস না তো খামোকা। এটা তোর জেণ্ডার থিয়োরির ক্লাস না। আর আমিও তোর স্টুডেন্ট নই। ” অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলে নীলাঞ্জনা।

“শোন, রাগ করিস না। আমি সত্যিই ওই বাড়িতে এখন কাউকে থাকতে দিতে পারব না। ভুল বুঝিস না প্লিজ।”

“ছেলে মেয়ে না থাকা, বর- শ্বশুর- শাশুড়ি নিয়ে সংসার না করার ফল এটা– জানিস তো? এই একলাসেরে মানসিকতা, কাউকে নিয়ে চলতে না পারা, কাউকে সহ্য করতে না পারা… “ঝাঁঝিয়ে ওঠে নীলাঞ্জনা।

অতর্কিত আক্রমণে বিপর্যস্ত আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বলি, “কে বলল আমি কাউকে সহ্য করতে পারিনা। আমার খুব ভালবাসার, স্নেহের মানুষদের লিস্ট কত লম্বা তুই জানিস?”

নীলাঞ্জনা কানেই তোলে না আমার প্রতিবাদ, “নিজের জগত থেকে বেরো দেবশ্রুতি। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে শেখ…” আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলেই চলে নীলু। কলেজে ওকে এই নামেই ডাকত সবাই।

ক্লান্ত লাগছে বুঝতে পেরে বিড়বিড় করি, “‘আমারই তো জগত, আমি গড়লে ক্ষতি কী!”

“উল্টো দিকের মানুষটাকে শত্রু ভেবে বাঁকা বাঁকা কথা বলাটা তোদের ফেমিনিস্টদের একটা রোগ দেবশ্রুতি!”

“নীলাঞ্জনা শোন, কারও সঙ্গে মতের অমিল হলেই সে শত্রু হয়ে যায় না। আর ফেমিনিস্ট শব্দটা মনে হচ্ছে তুই প্রায় গালাগালির মতো প্রয়োগ করলি। বেশ মজা পেলাম। তবে পুরনো বন্ধুরা গালাগাল দিতেই পারে। আজ রাখি কেমন? ভাল থাকিস।” ফোন রেখে দিই।

অযাচিত গালমন্দ শরীর ও মনের পক্ষে ভাল, আগেও বহুবার দেখেছি। রোজকার জীবনের একঘেয়েমিতে ঝিমিয়ে পড়া আমিকে চাবুক মেরে জাগিয়ে তুলতে এ একেবারে অব্যর্থ দাওয়াই!

নীলাঞ্জনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার ঠোঁটের কোণে মিচকে হাসি ফুটে ওঠে।

লিখেছেন-দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী সাংবাদিক, কলকাতা।



মন্তব্য চালু নেই