দাদা ছিলেন কৃষক, আমিও তার সঙ্গে লাঙ্গল ধরেছি : নাদিয়া

বৃটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯০তম জন্মদিনের কেক তৈরি করে সাড়া জাগানো দ্য গ্রেট ব্রিটিশ বেইক অব নাদিয়া হোসেইন বলেছেন, ‘আমার দাদা ছিলেন একজন কৃষক। ছোট বেলায় বাংলাদেশে গেলে তার সঙ্গে ক্ষেতে লাঙ্গল ধরেছি।’

স্থানীয় সময় বুধবার (০৪ মে) সন্ধ্যায় সেন্ট্রাল লন্ডনের কেভেনডিশ কনফারেন্স সেন্টারে তিনি এ কথা বলেন।

এশিয়া হাউস বাগড়ি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শুরু হওয়া দুই সপ্তাহব্যাপী লিটারেচার ফ্যাস্টিভ্যালের উদ্বোধনী নাইটে খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কলামিস্ট ইয়াসমিন আলিভাই ব্রাউনের সঙ্গে কথোপকথন অনুষ্ঠানে যোগ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের এই নারী।

অত্যাধুনিক কেভেনডিশ কনফারেন্স সেন্টারে টিকিট কেটে নাদিয়ার জীবনের গল্প শুনতে এসেছিলেন ব্রিটিশ সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। হল ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ।

ইয়াসমীন আলীভাই ব্রাউনের সঙ্গে কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশে নিজের গ্রামের বাড়ি নিয়ে কোনো স্মরণীয় ঘটনা আছে কিনা-তা জানতে চাইলে সহাস্যে নাদিয়া বলেন, ‘আমার দাদার শরীরের রং ছিলো কালো। ছোট বেলায় দাদার সঙ্গে ফসলের মাঠে লাঙ্গল ধরতে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম তোমার গায়ের রং এত কালো কেন? উত্তরে মজা করে হেসে হেসে তিনি বলেছিলেন আমার গায়ের রং খুবই ফর্সা ছিলো, কিন্তু ক্ষেতে-খামারে রোদের মধ্যে লাঙ্গল চালাতে চালাতে এই রং কালো হয়ে গিয়েছে।’

এ সময় নাদিয়া বেশ মজা করে নিজের শরীরের কালো রংয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ছোটবেলায় দেশে গেলে দাদার সঙ্গে ফসলের মাঠে লাঙ্গল ধরতাম বলে আমিও কালো হয়ে গেছি।’
নিজের গায়ের কালো রং সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাদিয়া আরও জানান, দ্য গ্রেট ব্রিটিশ বেইক অব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে তিনি যখন মিডিয়া আলোচনায় আসেন, তখন অনেকেই তাকে সুদানী বংশোদ্ভূত বলে মনে করতেন।

অনুষ্ঠানের লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (প্রেস) নাদিম কাদিরও উপস্থিত ছিলেন।

হল ভর্তি দর্শকদের সামনে রেখে ইয়াসমীন আলীভাইয়ের সঙ্গে এক ঘণ্টারও বেশি সময়ের আলোচনায় নাদিয়া তুলে ধরেন তার জীবনের নানা গল্প।

২০ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার আগ পযর্ন্ত প্রতি বছর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশে যাওয়া, ১২ বছর বয়সে প্রথম স্কুলের শিক্ষক কর্তৃক কেক বানানো দেখে চমৎকৃত হওয়া, গ্রামের বাড়িতে বাবা-চাচাদের নিয়ে দাদার যৌথ পরিবারের ছোটবেলার স্মৃতিময় সময় ইত্যাদি।

গল্পের প্রতিটি বাকেই ঘুরে ফিরে বারবার নাদিয়ার মুখে উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম, উচ্চারিত হয় তার বাঙালি ও মুসলিম পরিচিতির কথা। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে অতি বর্ষণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষেতের ধান তলিয়ে যাওযার বিষয়টিও জীবনের গল্পের অংশ হয়ে উঠে নাদিয়ার।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল আছেন কিনা, একজন প্রশ্ন কর্তার এমন প্রশ্নের উত্তরে নাদিয়া বলেন, ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো পারিবারিকভাবে তিনি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত।

সাম্প্রতিক সময়ে অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো সিলেটে তাদের পারিবারিক ফসলি জমিও তলিয়ে গেছে জানিয়ে নাদিয়া বলেন, ‘আমার বাবা-চাচাদের ক্ষেতের পাকা ধানও তলিয়ে গেছে ওই পানিতে। এসবই ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে।’

‘জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে অবশ্যই আন্তরিকতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে’, বলেন তিনি।

নাদিয়া বলেন, ‘বিয়ের আগে প্রতি বছরই বাবা-মায়ের সঙ্গে দেশে যেতাম। ফলে সেই ছোট বেলা থেকেই গ্রামে বসবাসরত আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে একটি যোগাযোগ তৈরি হয়। সেই থেকে দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে আমার অন্য ধরনের একটি ফিলিংস কাজ করে।’

তার সন্তানরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহী বলে জানালেন তিনি।

দর্শকদের অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী বলেন, ‘আমরা যেমন গর্বের সঙ্গে বারবার বলতে চাই, আমরা ব্রিটিশ, ব্রিটেন আমার দেশ, সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি ঠিক তেমনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শেকড়ের কথা।’

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি রানির জন্মদিনের কেক বানাতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, এমন কিছু দুঃখজনক মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। নাদিয়া বলেন, রানির জন্মদিনের কেক তৈরি করার খবর প্রচার হওয়ার পর ব্লিচ দিয়ে ভালোভাবে যেন হাত ধোয়ে যাই ইত্যাদি মন্তব্য শুনতে হয়েছে।

রান্না বা কেক বানানো কার কাছে শিখেছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাদিয়া বলেন ‘আমার সার্কেলটা ছিলো মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বামীকে ঘিরে’।

‘বেসিক রান্না বাবা-মায়ের কাছেই শিখেছি, দেশে গেলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে।’

তিনি জানান, তার বাবা একজন রেস্তোরাঁ শেফ, মা গৃহিণী। বাবা-মা দু’জনের কাছেই বেসিক কুকিং বিশেষ করে বাংলাদেশি খাবার রান্নার অনেক কিছু শিখেছেন। কিন্তু কেক সম্পর্কে তার আগ্রহ জন্মেছে ১২ বছর বয়সে স্কুলে।

নাদিয়া বলেন, ‘স্কুলে দেখলাম শিক্ষক ময়দা দিয়ে কি একটি তৈরি করে ওভেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন, বেশ কিছুক্ষণ পর এটি যখন বের করা হলো, তখন একটি সুন্দর মজাদার কেক হয়ে গেলো। তখন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। টিচারকে প্রশ্ন করেছিলাম কেমন করে কী হলো এটি। তিনিই তখন ধারণা দিয়েছিলেন কেক তৈরী সম্পর্কে। এরপর বাসায় এসে চেষ্টা করেছি, মা-বাবা ভাইবোনের উৎসাহ পেয়েছি।’

রানির জন্মদিনের কেক তৈরির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, তার তৈরি কেকের অংশ রানি বাড়িতেও নিয়ে গেছেন। তিনি মজা করে বলেন, ‘পরদিন রানির সঙ্গে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আমার বিশ্বাস ওবামাও আমার বানানো কেক খেয়ে গেছেন।’

আসছে জুনে রান্না বিষয়ক তার লেখা একটি বই বের হবে বলেও জানান নাদিয়া।

এগিয়ে গিয়ে ‘রানির জন্মদিনের কেক একটু বাঁকা কেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাঁকা নয়, একুশ ইঞ্চি উচ্চতার তিন টিয়ারের এই কেকের ডিজাইন পরিকল্পিত।’

গত বছরের ৭ অক্টোবর গ্রেট ব্রিটিশ বেক অব দ্য ইয়ার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাদিয়া হোসেইন। এরপর থেকেই মিডিয়ায় প্রায় নিয়মিতই সংবাদ হচ্ছিলেন তিনি। বাংলানিউজ



মন্তব্য চালু নেই