দিনাজপুরে ১৬টি সিনেমা হল বন্ধ!

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে : দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলার ১৬টি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯ সিনেমা হলের মধ্যে এখন মাত্র ৩টি খোলা রয়েছে। লোকসানের ভাড়ে বন্ধ হয়ে থাকা ১৬টি মধ্যে অধিকাংশই সদর উপজেলা শহরের। দিনাজপুর সদরের বোস্তান সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে চাল বাজার মার্কেট, লিলি সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে বাটা বাজার ও হাসনা প্লাজা মার্কেট, ফকিরপাড়া জুয়েল সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে আবাসিক বাড়ি, বিজিবি অডিয়াম কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, সদ্য বন্ধ হয়ে গেছে চৌরঙ্গী সিনেমা হল, একমাত্র চালু রয়েছে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত মর্ডান সিনেমা হল। একমাত্র এই সিনেমা হলটিও বন্ধের পথে বলে জানিয়েছেন, সিনেমা হলের মালিক পারভেজ।

বীরগঞ্জ উপজেলায় ২টি সিনেমা হলের মধ্যে একটি বন্ধ ও“ উল্লাস ”নামে একটি সিনেমা হল চালু রয়েছে। কাহারোল উপজেলার একটি মাত্র সিনেমা হল “উষা” তাও এখন বন্ধ রয়েছে। বোচাগঞ্জ উপজেলায় একটি মাত্র সিনেমা হল “আশা” বন্ধ রয়েছে। খানসামা উপজেলায় “চামেলি” নামের একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। বিরামপুরে “কেটি” সিনেমা হল রয়েছে বন্ধ। ফুলবাড়ী উপলোর ৩টির মধ্যে “উর্বশী” নামের একটি খোলা রয়েছে। হাকিমপুর উপজেলায় একমাত্র সিনেমা হল “হিরামতি” এখন ব্যবসায়ীদের গোডাউন ঘর ও পার্বতীপুর উপজেলায় “আশা টকিজ” ও “মধুমতি” সিনেমা হল রয়েছে বন্ধ।

এব্যাপারে দিনাজপুরের সিনেমা হল মালিকদের সাথে কথা বলে তারা জানান, নিন্মমানের ছবি, ছবির ভিতর কাট পিচের নামে অশ্লীল ছবি প্রর্শন, ডিশ লাইনের কারণে বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়মিত ছবি প্রদর্শন, ভারতীয় চ্যানেলের আগ্রাসন, ভিডিও পাইরেসি ও দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণসহ নানা কারণে সিনেমা হলগুলো দর্শক হারিয়েছে। এভাবে যদি সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী কলা কৌশলী, মালিক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কালচার, ইতিহাস-ইতিহ্য। যার কারণে সরকার হারাবে মোটা অংকের রাজস্ব।

এক সময়ের সিনেমা পাগল দর্শক জাকির জানায়,এক সময় মানুষের ঘরে ঘরে ছিল না টেলিভিশন, সিডি পে-য়ার বা ডিশের লাইন। তখন মানুষ বিনোদনের জন্য পরিবারের সকলকে নিয়ে ছুটে যেতে বিভিন্ন সিনেমা হলগুলোতে ছবি দেখার জন্য। স্বপরিবারে গিয়ে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মজাই ছিল অন্যরকম। সেই মজা ভুলে গিয়েছে সাধারণ মানুষ। আর সিনেমা দেখতে গলে যায় না মানুষ। এখন বাড়িতে বসেই টেলিশিনে ডিশ লাইনের মাধ্যমে, হাতের সামনেই সিডি বিক্রয় কেন্দ্র, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের মেমোরিতে সিনেমা লোড করে ইচ্ছে মতো সিনেমা উপভোগ করে। যার ফলে হলে গিয়ে সিনেমো দেখতে ভুলেই গেছে সাধারণ মানুষ। ফলে হলে চাকুরী করা শ্রমিকরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

৮০’ দশকে দেশের সকল সিনেমা হলগুলোর মতো দিনাজপুরের সিনেমা হলগুলো টিকিট কাউন্টার গুলোতে দর্শনাথীদের ছিল উপচে পড়া ছিড়। কে আগে টিকিট সংগ্রহ করে আগে ভেতর প্রবেশ করবে ছিল তার প্রতিযোগিতা।

এই প্রতিযোগিতা নিয়ে কখনো বা হয়েছে সংঘর্ষের ঘটনা। আর বিশেষ ছুটির দিনগুলো যেমন ইদ, পূজা, ২১ ফের্রুয়ারী, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ সকল সরকারী ছুটির দিনগুলোতে সিনেমো হলঘুলোর টিকিট চলে যেত কালোবাজারিদের হাতে। এসব কথা এখন গল্প হয়ে আছে দিনাজপুরের সিনেমা হলগুলোতে। প্রতিনিয়তই লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে সিনেমা হলগুলো। এতে করে বেকার হয়ে গেছে এ বিভাগের সাথে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীরা। সিনেমো হল বন্ধ হওয়ার পর অনেক কর্মচারী-শ্রমিকদের রিক্সা-ভ্যান, অটো রিক্সা চালাতে দেখা যাচ্ছে। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে এখন কোনো সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে মার্কেট, শপিংমল, পাইকারী ব্যবসায়ীদের গোডাউন ঘর।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই ভগ্নদশার নানাবিধ কারণ রয়েছে। অনেকেই এর জন্য পাইরেসি, চলচ্চিত্রের নিম্নমান, অশ্লীলতা এবং সিনেমা হলের কারণ দশাকে দায়ী করেন।

মর্ডাণ সিনেমার মালিক পারভেজ বলেন,‘পাইরেসি সিনেমা হলগুলোর এই ভগ্নদশার অন্যতম কারণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন হল মালিক লাখ টাকা খরচ করে ছবি কিনে নেন। তিনি যখন দেখেন সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবিটি হলের পাশের চায়ের দোকানে বসে লোকজন দেখছেন। তখন তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন ছবিটি কিনতে।’

তিনি আরো জানান, ‘সিনেমা হলে যাওয়ার আগেই বেশিরভাগ চায়ের দোকানেই সেইসব ছবি দেখতে পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, অনেকেই এই পাইরেসির সাথে জড়িত। হলে ছবি প্রদর্শনের আগেই তারা এসব ছবির কপি পেয়ে যান।

বর্তমানে মানুষ মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপে ছবি দেখতে পারে। অর্থাৎ বলা যায় ছবি মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। একটা সময় ছিল যখন সিনেমা দেখতে হলে মানুষকে সিনেমা হলে যেতে হতো।

তিনি আরো জানান, স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রের টার্গেট অডিয়েন্সেও পরিবর্তন আসে। সেসময় মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ছিল সিনেমা দর্শক। বর্তমানে সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন সিনেমার মূল দর্শক নিম্ন আয়ের শ্রেণির।

অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু নির্মাতাদের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ও খোলামেলা পোশাক প্রর্শনকেই দায়ী করেন নাট্যজন তারেকুজ্জামান তারেক। তিনি বলেন, সেসময় অধিকাংশ সিনেমাগুলো ছিল নোংরামিতায় ভরপুর, কুরুচিপূর্ণ ও নিম্নমানের। এসব কারণে সাধারণ মানুষ বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারকে নিয়ে সিনেমাতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।



মন্তব্য চালু নেই