দুই ভাইকে হত্যা করার লৌমহর্ষ বর্ণনা দিলেন সেই সৎ ভাই

১০ বছর আগে রেখা বেগম আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিনি আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। আমার পিতা তার সাথে পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হওয়ার পর তাকে বিয়ে করে। আমরা এ বিয়ে মেনে নিতে পারিনি। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৯ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক সাইফুল ইসলামের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এসব কথা জানায় ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ বর্ষের ছাত্র মো. আল শফিউল ইসলাম ছোটন। শফিউল ইসলাম ছোটন আরও বলেন- বিয়ের পর থেকে আমাদের সংসারে কলহ দেখা দেয়।

আমার বোনদের উপর চালানো হতো নির্যাতন, শেষ পর্যায়ে যখন জানতে পারি পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে- তখনই দুই সৎ ভাইকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসি। এরপর ঘটনার দিন সৎ ভাই জয়কে চিপস আনার জন্য দোকানে পাঠিয়ে রশি দিয়ে ছোট ভাই মনির হাত-পা বেঁধে ফেলেন তিনি। পরে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়। পরে জয় চিপস নিয়ে ঘরে ফিরলে তাকেও একই ভাবে হত্যা করি। এরপর ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে ঢাকায় চলে যাই।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর দক্ষিণ মডেল থানার এসআই আজিজুল হক জবানবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে সোমবার রাতে ঢাকা থেকে ছোটনকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে মিডিয়ার সামনে হাজির করা হয়। জবানবন্দির পর বিকেলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

জানা যায়, গত শনিবার কুমিল্লা মহানগরীর দক্ষিণ রসুলপুর (ঢুলিপাড়া) এলাকায় মেহেদী হাসান জয় ও মেজবাউল হক মনি নামে দুই শিশুর হত্যা মামলার একমাত্র আসামি মো. আল সফিউল ইসলাম ছোটনকে জেলা ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে।

ডিবির এসআই শাহ কামাল আকন্দ ও এসআই সহিদুল ইসলামসহ পুলিশের একটি টিম মোবাইল ট্র্যাকিং করে সোমবার রাত ১০টার দিকে রাজধানীর মালিবাগ টুইন টাওয়ারের সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করে। এরপর মঙ্গলবার ভোরে তাকে কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়। মঙ্গলবার তাকে কুমিল্লার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।

প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ঘাতক ছোটন তার দুই সৎ ভাইকে বালিশ চাপা দিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। ছোটন পুলিশকে আরো জানায়, বাবা আবুল কালাম প্রায় ১০ বছর আগে তার মা রোকেয়া বেগমকে রেখে রেখা বেগমকে বিয়ে করে। পরবর্তীতে বাবার পরের এ সংসারে নিহত জয় ও মনির জন্মের পর থেকে পিতা আবুল কালাম এবং সৎ মা রেখা বেগম তাদের (ছোটন, তার মা ও বোনদের) প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে ও লেখাপড়ার খরচ কমিয়ে দেয়। এরপর ছোট বোনকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে।

সর্বশেষ পৈত্রিক সম্পত্তি হতে তাদের বঞ্চিত করবে মর্মে জানতে পারে। পুঞ্জিভূত এসব ক্ষোভ থেকেই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোটন তার দুই সৎ ভাই জয় ও মনিকে হত্যা করে আত্মগোপন করে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আজিজুল হক জানান, বিকেলে গ্রেফতারকৃত ছোটন কুমিল্লার ৯নং আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ছোটন একাই দুই সৎ ভাইকে বালিশ চাপা দিয়ে ও গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।

জবানবন্দিতে ছোটন জানায়, সৎ মা রেখা আক্তার তাদের বাসায় ভাড়া থাকতো, আমরা তাকে (ছোটন) বোন বলে ডাকতাম, কিন্তু পরিবারের কাউকে না জানিয়ে সে আমার বাবাকে বিয়ে করে। হত্যার বিষয়ে ছোটন আরো জানায়, তার বাবা ও সৎ মা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগে দুই সৎ ভাইকে একা পেয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে।

দুপুরে চকলেট ও আইসক্রিম কেনার জন্য জয়কে দোকানে পাঠিয়ে প্রথমে মনিকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার করা হয়। পরে জয় বাসায় ফিরলে তাকেও বিছানায় ঘুমানোর কথা বলে একই কায়দার হত্যা করা হয়। এরপর পরে বাসার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ঢাকায় চলে যায়।

উল্লেখ্য, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে গত শনিবার বিকেলে কুমিল্লা মহানগরীর দক্ষিণ রসুলপুর ঢুলিপাড়ার আবুল কালামের ছেলে ছোটন তার দুই সৎ ভাইকে হত্যা করে। পরে তাদের মরদেহ ঘরের খাটের উপর রেখে ঘরের দরজায় বদ্ধ করে পালিয়ে যায়।

উল্লেখ্য, শনিবার (২৭ ফেব্র“য়ারি) কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ঢুলিপাড়ায় ঘরের মধ্যে শ্বাসরোধ ও গলায় দড়ি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় স্থানীয় মুদি দোকানদার আবুল কালামের দ্বিতীয় সংসারের দুই ছেলে জয় (৮) ও মনিকে (৬)। খবর পেয়ে বিকেল ৪টায় পুলিশ তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম সংসারের দুই সন্তান ছোটন ও তানজিনা পালিয়ে যায়। আবুল কালামের দুই সংসার। প্রথম সংসারে তিন মেয়ে ও এক ছেলে এবং দ্বিতীয় সংসারে ছিল দুই ছেলে জয় ও মনি। আবুল কালাম প্রথম ঘরের দুই সন্তান এবং দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার দুই সন্তানকে নিয়ে একই বাড়িতে থাকতেন।

কালামের দ্বিতীয় স্ত্রী রেখা বেগমের মা ঘটনার তিন দিন আগে মারা যান। শাশুড়ির মিলাদ মাহফিলে অংশ নিতে ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্ত্রী রেখা বেগমকে নিয়ে জেলার ব্রাক্ষণপাড়া উপজেলার শালদানদী এলাকায় যান তিনি।

এ সময় দ্বিতীয় সংসারের ছেলে জয় ও মনিকে প্রথম স্ত্রী রোকেয়া বেগমের দুই সন্তান ছোটন (ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ শিক্ষার্থী) ও তানজিনার (দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী) কাছে রেখে যান। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাড়ি ফিরে বিছানায় দুই শিশুর লাশ দেখতে পান কালাম ও রেখা।

শনিবার (২৭ ফেব্র“য়ারি) রাতে দুই শিশুর মা রেখা বেগম বাদী হয়ে সদর দক্ষিণ থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। এতে শিশু দু’টির সৎ ভাই ছোটনকে আসামি করেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই