দু’কেজি চাল পেলে সন্তান বেচতে রাজি যে মা

খাবার নেই, জল নেই, নেই ন্যূনতম ওষুধও। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার তলায় এতটুকু মাংস নেই, শুধু জিরজিরে হাড়। কঙ্কালসার সদ্যোজাতগুলোকে দেখে চমকে যাবে যে কেউ।

যুদ্ধদীর্ণ সিরিয়া। যেখানে মাত্র দু’কেজি চালের আশায় বুকের সন্তানকে বেচে দিতে চান মা। কিনবে কে? খদ্দেরও মেলে না। এক টুকরো পাঁউরুটির বিনিময়ে বিকিয়ে যায় শরীর। বছর খানেক আগে কিন্তু দেশটার এই হাল ছিল না। তার পর সিরিয়া জুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ক্রমশ দেশের বিস্তীর্ণ অংশের দখল নিতে শুরু করে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বন্দুকের চোখরাঙানি তো ছিলই, এ বার তার সঙ্গে জুড়ল খিদের লড়াই।

সিরিয়ার সপ্তম বড় শহর ডেয়ার এজ্‌র। তেল উৎপাদনে প্রথম সারিতে ছিল যে শহর, এখন সেখানে শুধুই হাহাকার। প্রত্যেক দিন একের পর এক শিশু অনাহারে, অপুষ্টিতে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। একই অবস্থা আর এক শহর মাদায়ার। কিছু দিন আগেও পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পাহাড়ি শহরে এখন শুধুই হাড়গিলে মানুষের সারি।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সিরিয়ার এই সব এলাকায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছেন মাত্র এক শতাংশ মানুষ। সব থেকে খারাপ অবস্থা শিশু ও বৃদ্ধদের। খাবারের অভাবে মরছে শিশু আর ওষুধের অভাবে মারা যাচ্ছেন বয়স্করা। বাজারে চড়া দামে খাবার বিকোচ্ছে অথচ রুটি-রুজির অভাবে সাধারণ মানুষের পকেট একেবারেই খালি। আইএসের হাতে বন্দি সিরিয়া এখন অচল।

সিরিয়ায় তবে আছেটা কী ?

হাহাকার আছে। গুলি-বোমা-বন্দুক আছে, ধর্মের নামে আইএসের জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির আছে।

প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সিরিয়াবাসীর জন্য রেশনের বন্দোবস্ত করলেও সেই সামান্য খাবার ফুরিয়েছে এক মাসেই। রাশিয়া থেকেও এসেছিল সাহায্য। তবু অনাহার মেটেনি। এখন সিরিয়াবাসীর কাছে বাঁচার রাস্তা একটাই— ছাড়তে হবে দেশ। তারপরেও থাকবে পালাতে গিয়ে প্রাণ হারানো আলান কুর্দির মতো শিশুরা। থাকবে শরণার্থী হয়ে টিকে থাকার প্রচণ্ড এক লড়াই।

আপাতত সে সব ভাবার অবকাশ নেই ডেয়ার এজ‌্‌র, মাদায়ার মতো শহরের বাসিন্দাদের। মাস তিনেক পৃথিবীর আলো দেখার সুজোগ পেয়েছিল ছোট্ট আকব।

বাজারে আকাশছোঁয়া দামের শিশুখাদ্য কিনে উঠতে পারেননি আকবের মা-বাবা। অপুষ্টিজনিত কারণে মা-ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারতেন না। তাই বাধ্য হয়েই গাছের রস খাইয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন কোলের সন্তানকে। পারেননি। রক্তাল্পতায় ভুগে মারা যায় আকব। তার মতোই আরও অসংখ্য শিশুর হয়তো এখন এটাই ভবিতব্য। এই সব রুগ্ন, অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা শিশুর ছবি সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই চমকে উঠেছে দুনিয়া।

কয়েক মাস আগেই আইএসের কব্জা থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন বৈদ্যুতিন জিনিসপত্রের বিক্রেতা আবু জুলফিয়ান। তাঁর কথায়, ‘‘প্রাতঃরাশ বা দুপুরের খাওয়া— এই শব্দগুলোই যেন সিরিয়াবাসীর কাছে অলীক এখন। বুনো গাছ থেকে কুকুর, বেড়াল, গাধা— এ সব অখাদ্যও এখন খিদে মেটাচ্ছে।’’

গৃহযুদ্ধের বাজারে খাবারের দাম এতটাই চড়েছে যে তার নাগাল পাওয়া মাদায়া বা ডেয়ার এজ্‌রের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আগে যে চালের দাম ছিল ভারতীয় মূল্যে ২০ টাকা, আজ সেই চাল বিকোচ্ছে ২৮০০ টাকায়। রান্নার তেলের দাম আগে ছিল লিটার পিছু ৩৫ টাকা, এখন সেটা বেড়ে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। গত নভেম্বর থেকেই গোটা দেশের কোথাও এতটুকু পাঁউরুটি পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের জন্য জলের সরবরাহও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পানীয় জলের জন্য ১০ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও হতাশ হয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে মানুষকে।

জুলফিয়ানের মতো গুটিকতক মানুষ সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ সিরিয়াবাসীই প্রতিনিয়ত জন্তু-জানোয়ারের মতো লড়ে চলেছেন খিদের সঙ্গে। খাবারের অভাবে মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছে। মাদায়া ও ডেয়ার এজ্‌রে অনাহারে ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে কয়েকশো শিশুর। হাসপাতালে আরও কয়েক হাজার মৃতপ্রায় শিশুর ভিড় বলে দিচ্ছে, এই মৃত্যুমিছিল সহজে থামছে না!

-আনন্দবাজার



মন্তব্য চালু নেই