ধর্ষণের ১৫ বছর পর ফেসবুকেও হয়রানি

ধর্ষণের পর পার হয়ে গেছে পুরো ১৫ বছর। শরীর ও মনের ক্ষত সেরে উঠে যখন একজন নারী ফিরতে চাইছেন তাঁর স্বাভাবিক জীবনে, ঠিক সে সময় আবারও ১৫ বছরের পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে সেই নারীকে হয়রানি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিকেই।

বলা হচ্ছে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার সময় প্রতিপক্ষের লোকজনের হাতে গণধর্ষণের শিকার পূর্ণিমা রানী শীলের কথা। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৩ বছরের কিশোরী পূর্ণিমার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এ ঘটনায় ১৭ জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা করেন পূর্ণিমা।

দুঃসহ সেই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সময়। এখন নিজ শহরে বাচ্চাদের গান শেখান ২৮ বছর বয়সী পূর্ণিমা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করেছেন। হঠাৎ একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেখতে পান তাঁর নাম, টেলিফোন নম্বর আর ছবি ব্যবহার করে খোলা হয়েছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট। সেখান থেকে আপত্তিকর সব ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। এমনকি পূর্ণিমার সহকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছে বন্ধু হওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে ওই ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে। ফলে পরিচিতজনদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন পূর্ণিমা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা নিজেই জানিয়েছেন পূর্ণিমা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনারও বিবরণ দেন তিনি।

বিবিসিকে পূর্ণিমা বলেন, ‘ওরা আমাকে এমন অবস্থায় যে হাতের ওপর করে তুলে নিয়ে কেউ খামচাচ্ছে, কেউ জামা-প্যান্ট টেনে খুলে ফেলছে। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে শ্মশানঘাট। সেই শ্মশানঘাটের মাঝে আমাকে একটা পতিত ক্ষেতের মধ্যে রেখে গণধর্ষণ করা হয়। আবার ওদের হাতের টর্চলাইটের আলোতে আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি।’

নতুন করে হয়রানির বিষয়ে পূর্ণিমা বলেন, ‘আমি ফেসবুক খুলতে গিয়েছি। দেখি আমার ছবি, আমার নাম দিয়ে একটা আইডি খোলা। সেখান থেকে পোস্ট করা হচ্ছে নোংরা ছবি, নোংরা কথা, আমার মোবাইলের নম্বর। কলিগদের সঙ্গে ওই আইডিটা যুক্ত হয়ে গেছে। ওরা আপন মনে করে সেভ করেছে, একসেপ্ট করেছে। তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কি রে দোস্ত তুই এমন নোংরা ছবি পোস্ট করছিস। তুই কি এগুলো করে খাস? আমাকে এক ফ্রেন্ড একদিন দোকানে বলছে, কত টাকা চাই তোর? স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এই তিনটা জীবনেই আমাকে ফেস করতে হয়েছে, এগুলোর জন্য আমি রাস্তায় হাঁটতে পারি না। অনেকেই আমাকে বলেছে, এই সেই মেয়েটা। অনেকে আমাকে রাস্তায় চুলের মুঠি ধরেও মেরেছে। আমার সঙ্গেই কেন এটা হচ্ছে? এটা কেন হচ্ছে? এর পরবর্তী আবার যখন আমি সার্চ করি, তখন আবার বলছে আমার কলিগটা, পূর্ণিমা তোমার কি লজ্জা বলতে কিছু নাই? এটা আমার লজ্জা না, এটা বাংলাদেশের সমাজের লজ্জা।’

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব হয়রানির কারণে এখন বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চান পূর্ণিমা। অন্য কোনো দেশে গিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চান তিনি। বিবিসির কাছে এমন আকাঙ্ক্ষার কথাই ব্যক্ত করেছেন তিনি।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জমার পর ২০১১ সালের মে মাসে ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা এবং জরিমানার অর্থ পূর্ণিমাকে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।



মন্তব্য চালু নেই