ধর্ষণে জন্ম শিশুর দায়ভার রাষ্ট্রের

আমাদের দেশে বিয়েবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌনমিলন অথবা ধর্ষণ-গণধষর্ণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এসব ঘটনার শিকার নারীরা বিচার না চেয়ে লোকলজ্জার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। ফলে, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ফসল হিসেবে তাদের গর্ভে বয়ে বেড়ায় হয় সন্তান। প্রশ্ন আসে, অনাগত এ শিশুর ভবিষ্যৎ দায়ভার কার? সম্প্রতি এমন একটি প্রশ্নের সমাধান মিলেছে।

গত ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একটি আদেশের মাধ্যমে ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া নবজাতকের দায়ভার রাষ্ট্রকে নিতে বলা হয়।

চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. রেজাউল করিম তার যুগান্তকারী আদেশের মাধ্যমে ধর্ষণের পর জন্ম নেয়া শিশুটি সাবালক হওয়া পর্যন্ত তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় আসামি মো. জসিমকে (৩৬) যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

ঘটনা অনুসারে, ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আপন চাচাতো বোনকে ধর্ষণ করে জসিম। কিন্তু জসিম পরে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পালিয়ে যায়। এঘটনায় ধর্ষিত নারী বাদী হয়ে ২০০৮ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি জসিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। তবে এ মামলার আসামি জসিম ঘটনার পর থেকেই পলাতক। অপরদিকে ধর্ষণের শিকার নারী পরে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন বলে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেসমিন আক্তার জানান।

এদিকে, ট্রাইব্যুনালের সদ্য দেয়া আদেশটি পরবর্তিতে এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী নজির হিসেবে উল্লেখিত হতে পারে বলে আইন বিশ্লেষকদের ধারণা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি ধর্ষণ ঠেকাতে না পারে তাহলে এর দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’

আনু মুহাম্মদ চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের যুগান্তকারী এ রায়টি ভালো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

তিনি আরো বলেন, ‘এসব শিশুর দায়ভার নেয়ার কোনো প্রস্তুতি আমাদের রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্রে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থানার সঙ্কট। শিশুকে প্রতিপালন করার জন্য নির্ভরযোগ্য, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো কাঠামো আমাদের নেই। এমনিতেই আমাদের দেশে বিভিন্ন শিশু শোধানাগার আছে। এগুলো সবক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য না বরং অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ অসুবিধাজনক।’

তবে আদালত যদি তার রায়ে রাষ্ট্রকে নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে এসব শিশুর জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানোর কথা বলতো, তাহলে আরো ভালো হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের অপরাধে একজন অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি অপরাধীর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এভাবে রাষ্ট্র অপরাধীর কাছ থেকে শিশুর দায়ভার নিতে পারে। নয়তো অপরাধীকে সনাক্ত করে সাজা দিয়ে শিশুর দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কারণ, এ দায়ভার আসামিকে দিলে সে কখনোই দায়িত্ব পালন করবে না। সেজন্য রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। এটা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।’

এদিকে, আদালত তার আদেশের মাধ্যমে আসামির কাছ থেকে এ দায়ভার গ্রহণের নির্দেশ দিলে এ আদেশটি অবশ্যই ইতিবাচক হতো বলে মন্তব্য করেন- বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

নির্দিষ্ট করে এ মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি না হলেও তিনি বলেন, ‘নীতিগতভাবে যারা ফৌজদারী মামলার শিকার হয় সেই সব ভিকটিমদের একটি রাষ্ট্রীয়খাত থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং সেই ক্ষতিপূরণ আসামির কাছ থেকে আদায় করা হলে নীতিগতভাবে এটি অবশ্যই ইতিবাচক। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের নজির আছে।’

গত ৫ নভেম্বর ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেয়া শিশু জন্মদাতার সম্পত্তির ওপর পূর্ণ অধিকার পাবার বিষয়ে এক যুগান্তকারী আদেশ দিয়েছেন। আর এমন শিশুদের যদি কেউ দায়িত্ব না নেয় তবে সরকারের তরফ থেকে সে পাবে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ।
একই সঙ্গে হাইকোর্ট তার আদেশে আরো জানিয়েছেন, শিশুকে প্রদেয় এ ক্ষতিপূরণ কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা থাকবে। শিশুটির ২১ বছর বয়স হওয়ার পর সে ওই টাকা ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া, শিশুটির পরিচয় যাতে কোথাও প্রকাশ না পায় তার দিকেও নজর রাখতে হবে।

কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্তকে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে প্রচলিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে প্রায়শই হিমশিম খেতে হয়। এছাড়া বিচার ব্যবস্থায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও নারীর ওপর দায় চাপানোর একধরনের মানসিকতা বিচারকে সমাজে হালকা করে তোলে বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষকরা। ফলে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ধর্ষিতা ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে।



মন্তব্য চালু নেই