নগরী সেজেছে বর্ণিল সাজে : কাল বর্ষবরণ

কে.এম জাহেদ, চট্টগ্রাম: নানা বর্ণিল আয়োজনে বর্ষবরণ ও বর্ষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বন্দরনগরী ও প্রাচ্যের রানীখ্যাত চট্টগ্রাম। বাংলা সনের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে বরণ করতে পুরো নগরী সেজেছে বর্ণিল সাজে। সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। নেয়া হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের সব ধরনের প্রস্তুতি।

চট্টগ্রামে বর্ষবরণ :
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের মূল কেন্দ্র ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এখানে পুরোনে বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার জন্য দুইদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থবকে নানা প্রামীণ পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও। চট্টগ্রামে সম্মিলিত ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসা এখনকবর ডিসি হিল পার্কে সরিয়ে নেওযা হয়। ১৯৭৮ সালের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুন দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন সুভাষ দে প্রমূখ। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে একটি স্কোয়াড গঠন করা হত। সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গাণ পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটকও যুক্ত হয়েছে। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর তিনদিন ব্যাপী উৎসা যা শেষ হয় বৈশাখের প্রথম দিবসে। নগরীর মহিলা সমিতি স্কুলে একটি বর্ষবরণ মেলা হয়ে থাকে।

পার্বত্য জেলায়, আদিবাসীদের বর্ষবরণ :
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। ত্রিপুরাদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিস্বত্ত্বা একত্রে এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি। উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো মার্মাদের পানি উৎসব।

পহেলা বৈশাখে চবিতে নানা কর্মসূচি :
পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বর থেকে শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। এরপর সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুল তলায় বসবে মূল অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এতে অতিথিরা বক্তব্য দেবেন। এরপর রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীদের পরিবেশনা, বলি খেলা, পুতুল নাচ, কাবাড়ি, বউচি, লাখি খেলা।এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা তো রয়েছেই। সবশেষে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বরেণ্য শিল্পী আবদুল জব্বার ও মনোরঞ্জন ঘোষাল এবং বাউল শিল্পী রণেশ ঠাকুর।

চট্টগ্রামের সিআরবিতে শত বছরের বলীখেলা :
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামীণ মেলা, ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, বলীখেলাসহ ব্যবসায়ীদের হালখাতা খুলে ক্রেতাদের সঙ্গে মিষ্টিমুখ করানো আবহমান বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় বাংলা নববর্ষ ছিল কেবল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উৎসব। সময়ের ব্যবধানে তা এখন বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রামের ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ :
চট্টগ্রামের ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণের সবচে বড় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। ‘সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ’-এর ব্যানারে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি আয়োজন করে আসছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতি কর্মীরা। এখানে ঢোলের বাড়ি, বাঁশির সুর, নাচ-গান আর বর্ণাঢ্য সব আয়োজনে পহেলা বৈশাখের কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। ডিসি হিল ও এর চারপাশ হাজার হাজার নারী-পুরুষের বৈশাখী সাজে রঙিন হয়ে ওঠে। এখানে এলেই বোঝা যায় বাঙালির প্রাণের উৎসবের আমেজ।

চট্টগ্রামের চারুকলা ইন্সটিটিউট পহেলা বৈশাখ :
নগরীর চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে ‘জাগো বাঙালি নবরূপে নব আনন্দে জাগো’ স্লোগানে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। চট্টগ্রাম চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সমন্বিত উদ্যোগে বের হয় এ শোভাযাত্রা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় বর্ষবরণ র‌্যালি। সকালে জারুল তলায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে থাকে নাটক, গান ও নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। দুপুরে মুক্তমঞ্চে বলী খেলা এবং বুদ্ধিজীবী চত্বরে কাবাডি, পুতুল নাচ ও বৌচি খেলার আয়োজন করা হয়।

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি পহেলা বৈশাখ :
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিও ৭ বছর ধরে বৈশাখী উৎসব করে উদযাপন করে আসছে। পহেলা বৈশাখের ভোরের সূর্য ওঠার পর সকাল ৮টায় জেলা প্রশাসনের আয়োজনে নগরীর সার্কিট হাউস থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে যাবে শিল্পকলায়। শিল্পকলায় নতুন বছরের শুরুর দিনে এবার ব্যতিক্রমধর্মী বৈশাখ উদযাপন করবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। প্রতিবার পান্তা-ইলিশে আপ্যায়নের আয়োজন থাকলেও এবার তা থাকছে না। জাটকা নিধনরোধে ইলিশবিহীন বৈশাখ আয়োজন করবে তারা। প্রতিবারের মতো অন্যান্য আয়োজন ঠিক থাকবে। নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দু’দিনের উসৎবের আয়োজন করে ‘চট্টগ্রাম উৎসব ও বর্ষবরণ পরিষদ’। আগের দিন বর্ষবিদায় ও পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্র-নজরুল-ডিএল রায়, অতুল প্রসাদ এবং লালন ও বাউল গানে সাজানো হয় এ আয়োজন। বিভিন্ন লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে। দেড়শ’ বছরের ইতিহাসে চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে বৈশাখকে ঘিরে নানা আয়োজনের ইতিহাস প্রবলভাবে সমৃদ্ধ। কেবল পহেলা বৈশাখ নয়; বৈশাখের পুরো মাস ধরে এখানকার গ্রামীণ সমাজে নানা আয়োজন শত বছরের ঐতিহ্য। ইংরেজদের শোষণের তীব্র বিরোধিতা করতে গিয়ে চট্টগ্রামের সওদাগর আবদুল জব্বার কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন এই বৈশাখ মাসেই। একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গৌরবের সঙ্গেই। বলী খেলাকে উপলক্ষ করে লালদিঘি মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী লোকজ মেলাও। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বৈশাখ মাসজুড়েই এ রকম কুস্তি বা বলিখেলা, গরুর লড়াই ও মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন হয়ে আসছে।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদীঘি ময়দানে প্রতি বছর ১২ বৈশাখ আয়োজন হয় শতবর্ষী জব্বারের বলী খেলা। এছাড়া বিগত তিন দশক ধরেই এরকম বেশ কয়েকটি আয়োজনের প্রথা চট্টগ্রামে চালু রয়েছে। বিশেষ করে নগরীর বাকিলয়ার বলীর হাটে ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াই, দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারায় পেঁচুমিয়া সরকারের বলি খেলা, পশ্চিম পটিয়ার মিয়ার হাটে মিয়ারো বলি খেলা, নোয়ামিয়ারো বলী খেলা, আনোয়ারায় নূর আহমদ চৌধুরীর বলীখেলা বিখ্যাত।



মন্তব্য চালু নেই