নতুন এক ‘মাশরাফি’র খোঁজ পেয়েছে বাংলাদেশ

নামের আদ্যক্ষরের সঙ্গে বেশ মিল—‘ম’। একজন মাশরাফি বিন মুর্তজা, অন্যজন মেহেদী হাসান মিরাজ। দুজনই এসেছেন খুলনা বিভাগ থেকে। একজনের কাঁধে দায়িত্ব জাতীয় দলের, অন্যজনের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের। ক্রিকেটীয় দিক বিবেচনা করলে এসব মিল হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে মাঠে ও মাঠের বাইরে দুজনের চরিত্রগত অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাচ্ছে একের পর এক সাফল্য। মেহেদীর ক্ষেত্রেও তা-ই। তাঁর নেতৃত্বেই যে দেশ-বিদেশে একের পর এক জয় পাচ্ছে অনূর্ধ্ব-১৯ দল।

মেহেদী নিয়মিত অধিনায়কত্ব করছেন ২০১৩ সাল থেকে। ওই বছর অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল সাত ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল ৪-৩ ব্যবধানে। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সিরিজ জিতিয়েছিলেন এই মেহেদীই। সাত ম্যাচে করেছিলেন ১২৭ রান ও বল হাতে পেয়েছিলেন ১৩ উইকেট। সিরিজসেরাও ছিলেন তিনিই।

গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে যুব বিশ্বকাপটা অবশ্য তাঁর ভালো যায়নি। যদিও বাংলাদেশ হয়েছিল প্লেট চ্যাম্পিয়ন। বল হাতে কিছুটা সফল হলেও (৭ উইকেট) ব্যাটিংটা খুব খারাপ করেছিলেন মিরাজ (১৯ রান)। এ বছর জানুয়ারিতে আবার নিজেকে ফিরে পান মিরাজ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশের যুবারা সিরিজ জেতেন ৩-২ ব্যবধানে। মেহেদী নেন ৯ উইকেট, ব্যাট হাতে করলেন ১০৫ রান। এমনকি দুই ম্যাচের যুব টেস্ট সিরিজটাও ড্র করে ফিরল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল।

গত এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষার কারণে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে ৬-১ ব্যবধানে জেতা সিরিজটা পুরোপুরি খেলতে পারেননি। ওই সিরিজে অধিনায়কত্ব করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। মেহেদী খেলতে পেরেছিলেন সিরিজের শেষ তিনটি ম্যাচ। তাতেই চিনিয়েছিলেন নিজের জাত। তিন ম্যাচে করেছিলেন ৬৩, ৫৭ ও ৬১ রান। বল হাতে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। এবারও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দারুণ শুরু করেছেন যুবারা। প্রথম দুই ম্যাচে জিতে সাত ম্যাচের সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দলকে মেহেদী জিতিয়েছেন অসাধারণ অলরাউন্ডার পারফরম্যান্সে।

বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন ফাহিম দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেছেন মেহেদীর নেতৃত্ব। গতকাল কথা হলো সাকিব-মুশফিকদের এই পুরোনো গুরুর সঙ্গে। নাজমুল মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মেহেদীর দারুণ নেতৃত্বের, ‘সাম্প্রতিক সাফল্যের পেছনে ওর নেতৃত্ব একটা বড় ব্যাপার। সে বিশ্বাস করে তার দল ভালো করতে পারে এবং সে বিশ্বাসটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। যেহেতু বয়সভিত্তিক দল। অল্প সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন খেলোয়াড় আসে এ দলে। নতুন খেলোয়াড়দের মধ্যেও ওই বিশ্বাসটা দ্রুত ঢুকিয়ে দিতে পারে ও। সবাইকে দারুণ উজ্জীবিত-উৎসাহিত করতে পারে।’

এ গুণটা জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফির ভেতর প্রবল। কাকে, কোথায় টোকা দিলে সেরাটা বেরিয়ে আসবে, মাশরাফির চেয়ে ভালো বুঝবে কে? দলে মাশরাফির যেমন গ্রহণযোগ্যতা, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে মেহেদীরও তা-ই। নাজমুল বললেন, ‘সতীর্থদের কাছে মেহেদীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ও নিজের ভালো জিনিসগুলো সতীর্থদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে।’

মেহেদীর আরেকটি গুণের কথা জানালেন বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের জাতীয় ম্যানেজার। শুনুন নাজমুলের মুখ থেকেই, ‘সে খুব বিত্তবান পরিবার থেকে উঠে এসেছে, তা নয়। নিজের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও কারও যদি ব্যাট, বুট প্রয়োজন হয়, নিজেরটাই দিয়ে দেবে। এটাও কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। সতীর্থদের সে বুঝতে পারে ভালো। এ জিনিসটাই অন্যদের থেকে ওকে পার্থক্য করে দেয়।’

২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত অনূর্ধ্ব-১৯ দল দেশে-বিদেশে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে মোট তিনটি। জিতেছে সবগুলোই। দলের সাফল্যের পেছনে অধিনায়কের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। দলকে যে নেতৃত্ব দিতে পারে সামনে থেকে, সেই তো সত্যিকারের নেতা। মেহেদীকে এ ক্ষেত্রে লেটার মার্কসই দিতে হবে। নাজমুল বললেন, ‘মেহেদী দারুণ পারফর্মার। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং—তিন বিভাগেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে। ঝুঁকি নিতে পারে। ব্যাটিং-বোলিংয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চাপ নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা আছে তার। ম্যাচের পরিস্থিতি দারুণভাবে বুঝতে পারে। সতীর্থদের খেলাটাও বোঝার চেষ্টা করে। সে অনুযায়ী, সবার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনে।’

যেহেতু অনূর্ধ্ব-১৯ দল খেলছে, জাতীয় দলে সুযোগ পেতে মেহেদীকে এখনো পাড়ি দিতে হবে বহু দূর। তবে স্বপ্ন দেখতে তো বাধা নেই। ভারতের বিরাট কোহলি, শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস কিংবা বাংলাদেশের সাকিব-মুশফিকরা তো এই অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়েই এসেছেন। ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে নিজেদের তৈরি করেছেন বহু আগেই। মেহেদীর ক্ষেত্রেও কি একই স্বপ্ন দেখা যায় না?

নাজমুল বললেন, ‘ভবিষ্যতের কথা সময়ই বলে দেবে। তবে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে। ও যদি জাতীয় দলে সুযোগ পায় আর নিয়মিত খেলে, তাতে হয়তো সুযোগটা আসতেও পারে। তবে এখন জাতীয় দলে এত পারফর্মার, সব ঠিক থাকলেও হয়তো পাঁচ-ছয় বছর পর অর্থাৎ যখন তার বয়স ২৫-২৬ বা তারও বেশি হবে, তখন দলের প্রয়োজনে ওকে অধিনায়ক হিসেবে দেখা যেতেও পারে। সে সামর্থ্য বা যোগ্যতার প্রমাণ এখন সে রেখে চলেছে। তার মূল কাজ এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।’ প্রথম আলো



মন্তব্য চালু নেই