নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত, আরও ৬ জনের মৃত্যু

উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা অপরিবর্তিত থাকলেও অনেক জায়গা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এসব এলাকার অনেক নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নদীভাঙন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট। লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ এখনও ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। রোববারও তিন জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে নারী-শিশুসহ মারা গেছে ছয় জন।

উত্তরের পানি নামতে শুরু করায় ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে বন্যা। মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর জেলার অনেক জায়গায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র নদীভাঙন।

মুন্সীগঞ্জ: শ্রীনগরের ভাগ্যকুল ও লৌহজংয়ের মাওয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও সদর উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী গ্রামসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

গাইবান্ধা: সদর উপজেলার বাদিয়াখালি ইউনিয়নের তালুক বুড়াইল (চুনিয়াকান্দি) এলাকায় রোববার দুপুরে আলাই নদীর সোনাইল বাঁধ ধসে বোয়ালি, বাদিয়াখালি, সাঘাটার পদুমশহর, ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া এবং উদাখালীর বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে তলিয়ে গেছে। ফুলছড়ি উপজেলার সব সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সদরের সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি অপরিবর্তিত থেকে বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুর: এখনও বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১০১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রোববার সকালে মাদারগঞ্জ উপজেলার দাঁতভাঙ্গা সেতুন অ্যাপ্রোচ সড়ক ভেঙে উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামপুর উপজেলার চরপুঁটিমারী গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে দুপুরে মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও একই ইউনিয়নের বেনুয়ার চর নয়াপাড়া গ্রামের মরিয়ম বেগম (৫৩) নামের দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। ভাটারা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের কাছে জামালপুর-সরিষাবাড়ী সড়ক ভেঙে যাওয়ায় জেলা শহরের সঙ্গে সরিষাবাড়ীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রাম: পানি কমতে শুরু করলেও নদীভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে গত শনিবার নদীভাঙনে মারু চন্দ্র দাস নামের এক ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছেন। ভেসে গেছে এই এলাকার অন্তত ২০টি ঘরবাড়ি ও ৫২টি গবাদিপশু। বিলীন হয়ে গেছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাগরাকুড়া গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ’ মিটার বাঁধ ভেঙে গুনাইগাছ ও বজরা ইউনিয়নের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত দু’দিনে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ছয়টি চর গ্রামের তিনশ’ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। চিলমারী উপজেলার সরকার পাড়া গ্রামে রোববার কারেন্ট জাল তুলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান ওসমান হোসেন (৫৫) নামের এক ব্যক্তি। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চিলমারী ডিগ্রি কলেজ মাঠসংলগ্ন পুকুর থেকে ফুটবল আনতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায় নবম শ্রেণির ছাত্র নাজিম মিঞা (১৪)।

সিরাজগঞ্জ: সদর, কাজিপুর, শাহজাদপুর, চৌহালী ও বেলকুচি উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর এবং গোহালা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শাহজাদপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উল্লাপাড়া উপজেলার মৈত্রবড়হর গ্রামের হুমায়ুন ইসলামের মেয়ে হাফজা (৩) ও কালিপুর গ্রামের সেলিম হোসেনের মেয়ে তৃষা (২) বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। এছাড়া গত শনিবার পাট জাগ দেওয়ার সময় সাপের ছোবলে মারা গেছেন মাটিকোড়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম (৪০)।

টাঙ্গাইল: ধনবাড়ীতে ঝিনাই ও বৈরান নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মুশুদ্দি ইউনিয়নের কসাইবাড়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে মুশুদ্দি, পাইস্তা, বলিভদ্র, ধোপাখালি ও হাদিরা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কসাইবাড়ী বাঁধের প্রায় ১২শ’ মিটার তলিয়ে গিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের টেউরিয়া নামক স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন করে ৫টি ইউনিয়নের ৪০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

মাদারীপুর: আড়িয়াল খাঁর প্রবল তোড়ে উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্ব কাকৈরে বহেরাতলা বাজার রক্ষা বাঁধের একশ’ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সন্ন্যাসীরচর, চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ির চার শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জাজিরা উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পূর্ব নওডোবা, বড়কান্দি ও কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের অনেক এলাকা ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

মানিকগঞ্জ: ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উথলী-পাটুরিয়া সংযোগ সড়কের একাংশে রোববার দুপুরের পর পানি উঠেছে। জেলার ৩০টি ইউনিয়নের ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

রাজবাড়ী: সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর, চরজৌকুড়া, বেনিনগর, রামকৃষ্ণপুর, চরনারায়ণপুর, বড়চর বেনিনগর, মৌকুড়ি, সিলিমপুর, বরাট ইউনিয়নের কাশিমনগর, নয়নসুখ, গোপালবাড়ি, উড়াকান্দা, ভবদিয়া, পাকুরিয়া, কালুখালী উপজেলার ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।

বাঘা (রাজশাহী): পদ্মার ভাঙনে উপজেলার চকরাজাপুর, দিয়ারকাদিরপুর, চৌমাদিয়া ও আতারপাড়া গ্রামের সহস্রাধিক আবাদি জমি ও বিভিন্ন ধরনের গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ): উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মিঠামইনের চরপাড়া, রাজীবপুর, শান্তিপুর, মহিষেরকান্দি এলাকা ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে। পানির তোড়ে মিঠামইন ঘাগড়া ডুবু সড়কের সংযোগ সেতুটি ধসে পড়ছে।



মন্তব্য চালু নেই