নতুন বছরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিশ্বনেতারা

২০১৬ সালে ইউরোপে ব্রেক্সিট ও আমেরিকায় ট্রাম্পের বিস্ময়কর জয়ে বিশ্ব যখন টামলমাটাল, তখন এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ শান্তই ছিল বলতে হবে। তবে কাছ থেকে দেখলে ২০১৬ সালটা এশিয়ার জন্য ঘটনাবহুলই মনে হয়। এর মধ্যে ফিলিপাইন নেতার আমেরিকাকে বিদায় জানিয়ে চীনের দিকে হেলে পড়া, দুর্নীতির কেলেংকারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের অভিশংসন থেকে শুরু করে ভারতের নোট বাতিল ছিল উল্লেখযোগ্য। এখানে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ২০১৬ সালে কী কী কাজ করেছেন এবং ২০১৭ সাল তাদের জন্য কেমন হতে পারে তা তুলে ধরা হল।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং: ৬৩ বছর বয়সী শি জিনপিং ২০১৬ সালে তার ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি তাকে ‘কোর’ তথা মূল নেতা বলে ঘোষণা করেছে। এ ঘোষণার ফলে তার ক্ষমতা আরও সুসংহত হয়েছে। আর এটা এমন একটি উপাধি, যা তাকে ২০১৭ সালে ক্ষমতার যে পুনর্বণ্টন হবে তখন তার হাতকে আরও শক্তিশালী করবে। প্রথমবারের জন্য জি-২০ সম্মেলনের আয়োজন করে শি তার ব্যক্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল করেছেন। তাছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির সামনের সারির একজন সমর্থক এবং ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রাক্কালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অঙ্গীকার করে চীনকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

২০১৭ সালে তার সামনে যে চ্যালেঞ্জ : ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে ট্রাম্পের কঠোর মানসিকতার জবাব প্রদান এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের মাঝে চীনের অর্থনীতি সঠিক পথে রাখার ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি: ৬৬ বছর বয়সী নরেন্দ্র মোদি গত কয়েক দশক ধরেই ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। তিনি ৮ নভেম্বর ভারতের ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বিলোপ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি আসলে দেখাতে চেয়েছেন, আধুনিক ভারত বিনির্মাণে তার দর্শন বাস্তবায়নে কোটি কোটি জনগণের ওপর কঠোর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার মতো যেকোনো ঝুঁকি নিতেও তিনি প্রস্তুত। ২০১৬ সালটা মূলত দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ কিছু বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান বজায় রেখে কেটেছে মোদির।

২০১৭ সালে মোদির সামনে চ্যালেঞ্জ : নোট নিষিদ্ধের পর নেতিয়ে পড়া ভারতের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। অন্যদিকে ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের নেতা নির্বাচনে লড়াই করা এবং যথাযথভাবে রাজস্ব আদায়।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে: ৬২ বছর বয়সী শিনেজো আবে দেশটির এক ধরনের সমর্থন নিয়েই ২০১৬ সাল শেষ করেছেন। এ সমর্থনের কারণেই হয়তো তিনি ২০১৭ সালে একটা নির্বাচন দিতে পারেন। নির্বাচিত হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিই সবেচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করা নেতা হওয়ার সুযোগ পাবেন। নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে আবের অভিপ্রায়কে উড়িয়ে দিয়েছে। বছরজুড়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভূখণ্ডগত বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা এবং জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্ল হারবার পরিদর্শনে যাওয়া উভয় দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

২০১৭ সালে শিনজো আবের চ্যালেঞ্জ : আমেরিকা-জাপান সম্পর্কের গুরুত্বের ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে সমঝোতার সঙ্গে সঙ্গে চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করা।

অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল: ২০১৬ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৬২ বছর বয়সী ম্যালকম টার্নবুলের পার্লামেন্টারি সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে যায় এবং তিনি আগের মেয়াদের চেয়ে এক আসন কম পান। নির্বাচিত হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি চাঙা করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তন ও সমলিঙ্গের বিয়ের মতো ইস্যুতে তার দলের পূর্ব অবস্থান পরিবর্তন করে নীতিনির্ধারণ করা তার জনপ্রিয়তায় বেশ ভাটা পড়ে। ২০১৭ সালে টার্নবুলের সামনে যে চ্যালেঞ্জ : ম্যালকম টার্নবুলের নিজ দলে তার আধিপত্য ধরে রাখা এবং নিজ দলের সম্ভাব্য নেতৃত্বকে দমিয়ে রাখা।

ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জোকো উইদোদো: ২০১৪ সালে নির্বাচিত ৫৫ বছর বয়সী জোকো উইদোদো ইন্দোনেশিয়ার ৭ম প্রধানমন্ত্রী। ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি সুরাকার্তার মেয়র এবং ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাকার্তার গভর্নর ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম দু’বছর উইদোদোর ভালোই কেটেছে। ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে নিজের অবস্থানের ব্যাপারে তার দলকে নিশ্চিত করেছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর এক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তিনি দেশটির পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর বিপুল সমর্থন কাজে লাগিয়ে তিনি গত জুনে একটি অবকাঠামোগত প্রকল্পের তহবিল গঠনে সহায়তা করতে বিতর্কিত এক কর রেয়াত বিল পাস করিয়ে নিয়েছেন।

২০১৭ সালে তার সামনে যে চ্যালেঞ্জ : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে তার যে পরিকল্পনা তা যে ঠিক পথেই এগোচ্ছে তা নিশ্চিত করা।

ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে: ফিলপাইনের ষোড়শ ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৭১ বছর বয়সী রদ্রিগো দুতের্তে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি আসিয়ানের প্রেসিডেন্ট থাকবেন। ২০১৬ সালের জুনে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশটিতে তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক সমালেচনা সত্ত্বেও মাদকবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এ নেতা। ২০১৭ সালে তিনি যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন তা হল- আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। এছাড়া ব্যবসায়ী ও সামরিক এলিটদের দিক থেকে তার ক্ষমতার প্রতি যে হুমকি রয়েছে তা মোকাবেলা করা।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক: মালয়েশিয়ার ৬ষ্ঠ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ৬৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ নাজিব রাজাক। আবদুল্লাহ আহমেদ বাদাবীর উত্তরসূরি হিসেবে ২০০৯ সালে তিনি মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন দল বরিসন ন্যাশনাল কোয়ালিশনের প্রধান দল ‘ইউনাইটেড মালয়েশিয়া ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে বরিসন জোট ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিরোধীদের তোপের মুখে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ কোম্পানি থেকে এক বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। নাজিবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিম সমকামিতার অভিযোগে বিচারাধীন রয়েছেন এবং বিরোধী দলগুলো প্রায় ছত্রভঙ্গ। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই একটি নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা সুসংহত করার দিকে মনোযোগী হচ্ছেন।

২০১৭ সালে নাজিবের সামনে যে চ্যালেঞ্জ : মালেয়েশিয়ায় বসবাসের খরচ যে দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরা এবং বিনিয়োগকারীদের খুশি রেখে বাজেট ঘাটতি সামলানো।



মন্তব্য চালু নেই