নতুন ‘স্লিপার সেল’র সন্ধান, টার্গেট উত্তরবঙ্গ

উচ্চশিক্ষিত ও ক্ষুরধার প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন নতুন একটি স্লিপার সেলের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই সেলের সদস্য সংখ্যা ১৫। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করাই এদের মূল লক্ষ্য। স্লিপার সেল বলতে গোয়েন্দা বা সন্ত্রাসী সংগঠনের একটি ঘাতক গ্রুপকে বুঝায় যারা নির্দেশ পাওয়ার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, নবগঠিত এই সেলটি পাঁচ মাসে সর্বমোট ১৪টি হামলা চালায়। এরমধ্যে টার্গেট কিলিং ৯টি। তবে ৫টি সফল হলেও ৪টিতে তারা ব্যর্থ হয়। বোমা হামলা ৪টি এবং দুইটি ডাকাতির ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয় নবগঠিত এই সেলটি।

গোয়েন্দা তথ্যে আরো জানা যায়, ২০১৪ সালে নয়া ১৫ জঙ্গির সমন্বয়ে তামিম আল আদনান নামের এক যুবক এই স্লিপার সেলটি গঠন করে। এই সেলের সব সদস্যই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। শুধু তা-ই নয় এদের রয়েছে ক্ষুরধার প্রযুক্তি জ্ঞান। সবমিলে এই সেলটিকে অতীতের সব সেলের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি স্মার্ট মনে করছে গোয়েন্দারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সদ্য গঠিত ইউনিট ‌‘কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’র প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে আমাদের ফোকাস ছিল তৎকালীন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতৃত্ব থানা হবিগঞ্জের সাবেক জামায়াত নেতা মাওলানা সাঈদুর রহমানের ওপর। পরে ২০১০ সালের ২৪ মে দিবাগত রাতে রাজধানীর দনিয়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দা হেফাজতে একটি স্লিপার সেলের তথ্য দেন। সেই তথ্যানুযায়ী আমরা ওই সেলটিকে নজরদারিতে রাখি। এবং একটা সময়ে তাদের অনেকটায় নিষ্ক্রিয় করে খেলতেও সক্ষম হয়।’

‘কিন্তু একই সময়ে মাওলানা সাঈদুর রহমানের মতাদর্শে বিশ্বাসী নন, এমন আরেকটি স্লিপার সেল গঠন করে জঙ্গিরা। তামিম আল আদনান নামের এক যুবক ওই সেলটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করেন। ওই সেলের ১৫ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মাত্রার প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন। এরাই পরিবর্তী সময়ে ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হত্যার তালিকা তৈরি করে কিলিং মিশন শুরু করেন’, বলেন মনিরুল ইসলাম।

বর্তমানে তাদের অবস্থান কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই সেলটিকেও আমরা কিছু দিন আগে ট্রেস করতে সক্ষম হয়েছি। এদের টার্গেটেড এরিয়া উত্তরবঙ্গ। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টির আড়ালে থেকে জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতেই তারা এই কৌশল অবলম্বন করেছে।’

‘তবে খুশির সংবাদ এই যে, ইতিমধ্যেই আমরা তাদের নজরদারিতে এনেছি। তাদের সকল কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তামিম আল আদনান ছাড়াও আরো কেই এই স্লিপার সেলের পেছনে রয়েছে কিনা সেটিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে’, বলেন মনিরুল ইসলাম।

২০১৫ সালের ৩ অক্টেবর রংপুর জেলার কাউনিয়ায় জাপানি নাগরিক হুশি কুনিও হত্যার মধ্যদিয়ে নবগঠিত এই স্লিপার সেলের যাত্রা শুরু হয়। এর ঠিক দুই দিন পরে তারা পাবনার ঈশ্বরদিতে খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যা চেষ্টা করে। কিন্তু ওই মিশনটিতে তারা ব্যর্থ হয়।

একই বছরের ৮ নভেম্বর তারা রংপুর জেলার কোতোয়ালি থানা এলাকায় রুহুল আমিনকে হত্যার মিশন চালায়। কিন্তু এই মিশনটিতে নবগঠিত এই স্লিপার সেল ব্যর্থ হয়। তবে ব্যর্থতার দায় খুব বেশি দিন তাদের টানতে হয়নি। রুহুল আমিনের কিলিং মিশন ব্যর্থ হওয়ার মাত্র দুই দিন পরই তারা একই এলাকায় খাদেম রহমত উল্লাহকে হত্যা করে। এরপর ঠিক পরের দিনই তারা সৈয়দপুরে আরেকটি মাজারের খাদেমকে হত্যার মিশন চালায়। কিন্তু সেই মিশনে তারা সফল হতে পারেনি। ৫ দিন বিরতি দিয়ে ১৮ নভেম্বর রংপুরে ডা. পিয়েরো পারোলকি নামের এক ইতালীয়কে হত্যার মিশন চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এই সেলটি বগুড়ার একটি শিয়া মসজিদে নামাজরতদের উপর হামলা চালায়। ওই হামলায় মসজিদের মোয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৭০) নিহত হন। আহত হন ইমাম শাহিনুর রহমান (৬০), তাহের মিস্ত্রি (৫০) ও আফতাব আলী (৪০)।

একই বছরের ডিসেম্বরের ৫ তারিখে তারা বোমা হামলা চালায় দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার ঐতিহাসিক রাসমেলায়। তবে ওই হামলায় কেউ নিহত না হলেও আহত হন অন্তত ৬ জন। এর ঠিক ৬ দিন পর ১১ ডিসেম্বর নবগঠিত স্লিপার সেলটি দিনাজপুরের কাহারোলের ইসকন মন্দিরে বোমা হামলা চালায়। একই দিনে তারা দিনাজপুরের দিপ্তি ফিলিং স্টেশনে ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলার বাগমারা থানা এলাকার ‘আহমদিয়া মুসলীম জামাত’ নামের একটি মসজিদে হামলা চালানো হয়।

গাইবান্ধার হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রী তরুণ দত্তকে হত্যার মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের শুরু করে নবগঠিত স্লিপার সেলটি। ৮ ফেব্রুয়ারি ওই ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় পঞ্চগড়ের মঠপ্রধান যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়। সবশেষ ২২ মার্চ কুপিয়ে হত্যা করা হয় কুড়িগ্রামের গাড়িয়ালপাড়ায় খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে।বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই