নাইজারের সেই মৎস্যজীবীদের বদলে যাওয়া জীবন

গত জানুয়ারির শুরুর দিকে তেল কোম্পানি ‘শেল’ এর সাথে রফার খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পরপরই জন জেবারা ও তার স্ত্রী নতুন আশায় বুক বাঁধেন। কিছুদিন পরই প্রত্যেকেই ৬ লাখ নাইরা (নাইজারের মুদ্রা) করে ক্ষতিপূরণ পান যা তিন হাজার মার্কিন ডলারের সমমান। এবং তাদের জন্য একসাথে পাওয়া প্রথম বড় অংকের কোনো আর্থিক সহায়তা।

এর নয় মাস পর বদ্বীপ নাইজারের মৎস্যপল্লী বোদোতে ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য একটি নতুন তিন কক্ষের ইটের ঘর নির্মাণ করেন এই একসময়কার মৎস্যজীবী। পাইপলাইন ফেটে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বোদো সম্প্রদায় তেল কোম্পানি রয়্যাল ডাচ শেলের এর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আদালতে মামলা করে। মামলার রায় অনুযায়ী কোম্পানিটি তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার দিতে হয়। এই অর্থ কোনো নেতার হাতে না দিয়ে সরাসরি বোদো সম্প্রদায়ের ১৫ হাজার মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যা ছিল মোট বোদো অধিবাসীর চার ভাগের একভাগ।

তেল দুর্ঘটনার প্রায় ছয় বছর পর এই ক্ষতিপূরণ বুঝে পেলেন জেবারাসহ বাকিরা। সেদিনের কথা আজও ভূলতে পারেননি তিনি। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে বোদো গ্রামে তেলের পাইপলাইন ছিদ্র হয়ে ১০ হাজার ব্যারেল তেল আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। টানা ৭২ দিন ধরে চলা এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে চুঁইয়ে পড়া তেলে বোদোর ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পুরোপুরি ধবংস হয়ে যায় এই এলাকার মৎস্য আহরণ অঞ্চল।

‘আমরা বর্ষায় মাছ ধরতে যেতাম ভরা পূর্ণিমায়। কারণ এই সময়টায় মাছ বেশি ধরা পড়ে। কিন্তু সেই দিনের পর থেকে আমরা আর মাছ ধরতে পারছি না’, -বলছিলেন জেবারা। এখন তাকে মাছ ধরার জন্য বোদো থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে যেতে হয় ঠিকই কিন্তু তিনি যে পরিমাণ মাছ ধরেন তা আগের তুলনায় অর্ধেক। ‘তেলের কারণে এখন আর মাছ আসে না,’ বলেন তিনি।

2015_09_17_20_50_56_hAfAgLjQ8OgIDUgGoxxTQGpy3NafF8_original
ক্ষতিপূরণের টাকায় বানানো ইটের বাড়ি

মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবার কাছে শেখা মৎস্য শিকারই ছিল তার একমাত্র পেশা। এই দুর্ঘটনায় তার মাছ ধরার আশা প্রায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল। রয়্যাল ডাচ কোম্পানির সেই চুক্তির আগে জেবারা এবং তার স্ত্রী বিভিন্ন পেশায় নিজেদের ও পরিবারের জীবনধারণের চেষ্টা করেছেন। কখনও বা প্লাস্টিকের বোতলে তেল বিক্রি আবার কখনো কৃষিকাজ। কিন্তু কৃষিকাজেও আগের মতো লাভবান হওয়া কঠিন ছিল। কারণ চুঁইয়ে পড়া তেল আবাদি জমিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

২০১৩ সালের দিকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আগে তারা ভেবেছিল, তারা হয়তো সন্তানদের স্কুলের খরচও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এর মাত্র দুই বছর পর এই ৪২ বছর বয়সী বাবা তার নিজের পাকাবাড়িতে বসে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে জানান দিচ্ছিলেন তার সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন নিরাপদ। তারা এখন প্রতি মাসে তাদের শিক্ষা খরচ বাবদ ৫০ হাজার নাইরা খরচ করতে পারেন।

আড়াই বছর বয়সী জ্যানেট যখন বাবার কোলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বাবা বলছিলেন তার স্বপ্ন পূরণের উপাখ্যান। তার ভাষায়, ‘এটা যথেষ্ট নয়, কিন্তু জীবনকে সহজ করে দিয়েছে’। তার জীবনের একটি আশা ছিল যে তিনি তার পরিবারের জন্য একটি ইটের পাকাবাড়ি নির্মাণ করে দেবেন। তার সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে তার নিয়মানুবর্তিতা আর ত্যাগের বিনিময়ে। তাদের এই বাড়িটির নির্মাণের সময়ে তাদের পুরো পরিবারকে প্রতিবেশীর বাড়ির একটি কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছিল।

2015_09_17_20_50_53_EnbirivyxFMHz1TKP9Ji92EA8IKJFT_original

তাদের সেই কষ্টের দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে জেবারা বলেন, ‘তুমি কি একটা কক্ষে এতগুলো মানুষ থাকার কথা কল্পনা করতে পারো? আমি চাচ্ছিলাম খুব তাড়াতাড়ি যেন পরিবারের জন্য ঘরটি নির্মাণ করতে পারি। তাই আমি নিজ হাতে কাজ করছিলাম।’

টাকা পাওয়ার শুরুর দিকে জেবারা কৃষিকাজের পাশাপাশি একটি মাছ ধরার নৌকার ইঞ্জিন কিনতে চেয়েছিলেন কিন্তু যখন দেখলেন যে তাহলে তাদের ঘর তৈরির টাকায় টান পড়বে তখন ইঞ্জিন কেনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে এই আর্থিক সহায়তায় তাদের ক্ষতি পূরণ হয়েছে কি না। তিনি শুধু বলেন, ‘তাদের উচিৎ এই পানিকে পরিষ্কার করা। আমাদের জীবিকাকে বাঁচানো। এই মুহূর্তে এটাই গুরুত্বপুর্ণ কাজ। তারা (রয়্যাল ডাচ শেল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) বলেছে যে, আগামী মাস থেকে কাজ শুরু হবে। তারা আসুক আর কাজ শুরু করুক। আমাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিক।’

যদিও ক্ষতিপূরণের টাকায় বানানো জেবারার বাড়িটির সিলিং এবং দু’এক জায়গায় পলেস্তারা এখনো লাগানো হয়নি তবুও এই মানুষটি চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে নির্দ্বিধায় বলেন, ‘আমার এই ঘরটি আমার কাছে তেমনভাবেই সুন্দর ঠিক যেমন আমার স্ত্রী আমার কাছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর নারী!’



মন্তব্য চালু নেই