নিজামীর মরদেহ পাবনায় ঢুকতে দেয়া হবে না

পাবনা : শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতে মতিউর রহমান নিজামীর মরদেহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পাবনার মাটিতে ঢুকতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন জেলা, সদর উপজেলা ও নিজামীর নিজ এলাকার তরুণ প্রজন্ম ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা।

আর মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, কুলাঙ্গারের অবসান হবে ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিশেষ করে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে এই নিজামী যে হারে হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ধর্ষণে সহায়তা করা, বাড়িঘর লুট করেছে, সেই অপরাধের ধারাবাহিকতায় মৃত্যুদণ্ডই ছিল তার একমাত্র সাজা। যে সাজা কার্যকরের পথে। ফাঁসি কার্যকর হওয়া মানে বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্নের সোনারবাংলা রাজাকারমুক্ত, কুলাঙ্গার মুক্ত হওয়া।

এদিকে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত আসামি জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে এমন খবরে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন তার আত্মীয় স্বজনরা। স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন নিজ জন্মভূমি সাঁথিয়ার মনমথপুরের পড়শীরা।

স্বজনরা বলছেন, টেলিভিশনে খবর দেখে সঠিক তথ্য জানার আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো তথ্য নিশ্চিত করা হয়নি। গত রাতে মনমথপুরের স্বজনদের সঙ্গে আলাপকালে তারা এমন কথাই জানালেন। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামের লুৎফর রহমান খানের একমাত্র ছেলে। তারা ৩ ভাই-বোন।

গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে অনুভূতি প্রকাশ করলেন নিজামীর ভাতিজা আব্দুর রহিম। তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী আমার চাচা। তিনি মানুষ হিসেবে একজন সৎ ও ভালো মানুষই ছিলেন।’

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী এবং পরোপকারী এমন দাবি করে বলেন, ‘এমন মানুষ তিনি কখনও কারও ক্ষতির কথা চিন্তা করেননি। আর তার সম্পদ বলেও আমার জানা মতে কিছু নেই। যা আছে তা সবই ছেলে-মেয়েদের। মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের ওপর ভর করে সরকার তার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছে।’

তিনি জোর দাবি করে বলেন, ‘তার চাচা আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ নির্দোষ। সরকারের রায়ে তো আর তাদের হাত নেই। এখন এটা মেনে নেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। আত্মীয়-স্বজনরা মসজিদে ও বাড়িতে দোয়া দরুদ ও কোরআন খতম করে দোয়া করছেন। তাকে আল্লাহ হেফাজত করবেন।’

নিজামীর চাচাতো ভাই আনছার আলী সাংবাদিকদের কাছে জানান, ‘এবা আলেম কয়ডা আছে, সে যে দ্যাশের সম্পদ। সরকার বড়ই ভুল করতেছে, আমার বাইয়ের মতো সুন্মানী আমলকারী লোকেরে ফাঁসায়ে ফাঁসি দেচ্ছে। এতা হারালো কোনো দিনই পুরুণ হবিনানে।’

নিজামীর ভাতিজা আব্দুল মজিদ ওরফে মানিক খানের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে টিবিত এসব খবর শুনতিছি।’

এলাকার যুবক আল-আমিন, ফয়সাল, মাহমুদ, রিপন, জুয়েল, মিম, ছালাম এরাও সাংবাদিকদের জানান, রাজনীতি মাজনীতি বুঝিনি। সে যে আমাদের গৌরব ছিলি এটা জানি। এমন মানুষকে ফাঁসি দেচ্চে খুব কষ্টতো হচ্ছেই।’

নিজামীর গ্রামের আত্মীয়-স্বজনরা জানায়, তার বাবা-মা গ্রামের মনমথপুর গোরস্থানে শায়িত আছেন। তিনি গ্রামে আসলেই তাদের কবর জিয়ারত করতেন এবং বলতেন তাকেও যেন এখানে কবর দেয়া হয়।

এদিকে, বাঁধ সেধেছে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক ধারক ছাত্রলীগ তথা প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চাকারীরা। পাবনা সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক আরমান হোসেন বলেন, ‘দাদু-নানুর মুখে শুনেছি। নিজেরা দেখিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে এই কুলাঙ্গার রাজাকার নিজামী যে অন্যায় করেছে। তা আমরা তরুণ প্রজন্ম শুনেই মেনে নিতে পারিনি। তাকে ফাঁসি রায় দেয়া হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে। সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি অভিযোগের আলোকে উপযুক্ত শাস্তি হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করছি।’

আরমান আরও বলেন, ‘পাবনার এই পবিত্র মাটি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই পুণ্যভূমিতে রাজাকারের মরদেহ প্রবেশ করতে দেব না। আমরা ছাত্র সমাজ এটা প্রতিহত করতে বদ্ধ পরিকর।’

সাংস্কৃতিক কর্মী আবুল কাশেম বলেন, ‘দেরীতে হলেও কুলাঙ্গার, আলবদর বাহিনী প্রধান, কুখ্যাত রাজাকারের কলঙ্কিত অধ্যায় বন্ধ হতে যাচ্ছে এমন সংবাদ শোনার পর পাবনার মানুষ হিসেনে গর্বিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এবার বুঝি দীর্ঘ ৪৪ বছর পর হলেও কলঙ্কমুক্ত হতে চলেছে।’ তিনি রায় কার্যকরের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

এদিকে, বামপন্থি সংগঠন ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কমরেড জাকির হোসেন বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে নিজামীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়িঘরে লুটতরাজ করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে। সেই কুলাঙ্গার নিজামীর ফাঁসির রায় দেরিতে হলেও কার্যকর হতে যাচ্ছে এমন সংবাদ জানার পরপরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি।’ তিনি এই রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়াকে সাধুবাদ জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমাণ্ডার আব্দুল বাতেন আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজ যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে এমনটি জানার পর আবেগ ধরে রাখতে পারছি না। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজ সত্যিই গর্বিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের দিকে যাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অবিলম্বে দেশের আরও যে সকল যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। তাদেরও দ্রুত বিচারের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দিয়ে সোনার বাংলাকে রাজাকার তথা যুদ্ধাপরাধী কুলাঙ্গারমুক্ত করতে হবে। এখনই উপযুক্ত সময়। এদের চিরতরে এই সোনার বাংলা থেকে মুছে ফেলতে হবে।’



মন্তব্য চালু নেই