নিজের কবর নিজেই বানালেন আব্দুল গণি

চৈত্রের এক সকালে এক বৃদ্ধকে দেখা গেল, কোদাল হাতে নিবিড়ভাবে মাটি কাটছেন, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাটি চালাচালি করছেন, উচু নিচু অংশগুলো সমান করছেন। যেন শস্য বোনার জন্য নিবিড় পরিচর্যায় মেতে উঠেছেন। চৈত্রের সকালে ধুলো ধূসরিত বাঁশ ঝাড়ের ফাঁকা অংশে একটা আটো সাটো জায়গায় কোদাল চালাতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগল-এমন রুক্ষ শুষ্ক পোড়া মাটিতে বৃদ্ধের এই নিরর্থক পরিশ্রমের কারণ কী? প্রশ্ন করলাম-কী করছেন? এ প্রশ্ন কানে পৌছতেই থমকে গেলেন। কোদাল থামিয়ে কাছে আসলেন, চোখে মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেল বৃদ্ধের। পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে বললেন, কবরের জায়গা তৈরী করছি। কার জন্য? আমার নিজের ও স্ত্রীর জন্য।

সন্তান-সন্ততি পরিবেষ্টিত আব্দুল গণি কারো উপরই যেন ভরসা পাচ্ছেন না, -কে দেবে তিন হাত পরিমান জায়গাটুকু, কোথায় হবে তাঁর অন্তিম শয্যা। না, না সন্তান, না নাতী-নাতনী, না জ্ঞাতি-গোষ্ঠী কিংবা আত্মীয়-স্বজন কারো উপরেই নির্ভর করতে পারছেন না তিনি । তাই সত্তর বছরের বৃদ্ধ গণি মিয়া কোদাল হাতে নিজেই নেমে পড়েছেন নিজের এবং প্রীয়তম স্ত্রীর কবরের জায়গা তৈরীতে। সভ্য মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রত্যক্ষ রূপ যেন আব্দুল গণি।

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা ইউনিয়নের জমগ্রাম ডাংগাপাড়া এলাকার আব্দুল গণি তিন কন্যা ও চার পুত্র সন্তানের জনক। রেজাউল করিম (৪০),রবিউল (৩২), রাবিউল(২৮) মিলন(২৫)।
লেখনীর মধ্য দিয়ে জীবনকে ভালবাসতে শিক্ষা দিয়ে ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী’ খ্যাত আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। গণি মিয়ার আত্মহত্যার ইচ্ছা নেই। তিনি জীবন এবং মৃত্যু দুটোকেই ভালবেসে আজ কবর পথের যাত্রী।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে লিখেছিলেন ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সম’। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন পরপারে যাওয়ার খেয়া হিসেবে। নতুন জীবনে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে। শ্বেত শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত এই বৃদ্ধও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরলোকে প্রবেশের আনন্দ নিয়ে বৈকি। জীবনের অনিবার্য সত্যকে এত হালকাভাবে এত সহজভাবে মেনে নেয়ার ইচ্ছাশক্তিতে আব্দুল গণি তৃপ্ত। ওপারের জন্য সঞ্চিত পাথেয়ই কি তাকে নির্ভয় নির্ভার করে তুলেছে?

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণ পুরুষ জীবনানন্দের কবিতার নায়ক অনির্ণেয় অপরিচিত এক বিষন্নতা থেকে মুক্তির জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। না অর্থ-বিত্ত,না প্রেম-ভালবাসা, না কোন নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হওয়ার জ্বালা, না হার হা-ভাতের জ্বালা-কোন কিছুর জ্বালাই সইতে হয় নাই কখনো, তারপরও মরার সাধ জাগে। এই বৃদ্ধের মৃত্যুচিন্তা এ ধরনের কোন বোধ থেকে উদ্ভূত নয়-মৃত্যু তাঁর কাছে আনন্দের, অনন্তের পথে প্রবেশের মাধ্যম।

আব্দুল গণি বললেন ছেলেরা ভাত কাপড়ের চাহিদা মেটাচ্ছেন, কিন্তু অন্তিম শয্যাটুকু নিয়ে মাঝে মধ্যেই চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারো উপর ভরসা পাইনা। তাই নিজের শেষ শয্যাটুকু নিজেই তৈরী করে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে কবরের জায়গা করলেন কেন? জানতে চাইলে বললেন, রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে মানুষ কবর দেখে ফাতেয়া শরীফ পাঠ করবে, কবরকে সালাম জানাবে। মানুষের দোয়ায় আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন, পরকালে শান্তি পাব। কথা হয় আবুল গণির প্রতিবেশী পাড়ার মসজিদের ইমাম আব্দুল আলীর সাথে।

আব্দুল আলী বললেন,‘আব্দুল গণি পরহেজগার মানুষ। তাবলীগ করেন। সব সময় মৃত্যুর জন্য নিজেকে তৈরী রাখেন।’

আধুনিক সভ্যতা মানুষকে কতটুকু সংশয়প্রবন করে তুলছে আব্দুল গণি তার প্রত্যক্ষ রূপ। রবীন্দ্রনাথের পোস্ট মাস্টার শেষ পর্যন্ত রতনকে সাথে নিতে না পেরে দার্শনিক প্রতীতি নিয়ে উচ্চারন করেছেন‘পৃথিবীতে কে বা কাহার’। আব্দুল গণির মধ্যেও কি এমন প্রতীতি জন্মেছে যে, তিনি কারো উপরেই ভরসা পাচ্ছেন না তাঁর শেষ শয্যাটুকু তৈরীর জন্য।



মন্তব্য চালু নেই