নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারীর জন্য ১১ রাষ্ট্রীয় সুবিধার প্রস্তাব

গত পাঁচ ধরে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করে আসছেন এমন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১১ ধরনের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদানের সুপারিশ জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি এসব সুপারিশ প্রস্তাব আকারে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দিলে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এনবিআর সূত্র আরও জানায়, নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করেন যারা, তাদের জন্য সুপারিশ করা ১১ সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবসার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, বন্দরের বিশেষ চ্যানেল দিয়ে দ্রুত পণ্য খালাস, সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে সরকারি চিকিৎসা ব্যয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্লট বরাদ্দ, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের ইউটিলিটি (গ্যাস, বিদ্যুত, পানি) সংযোগ, পরিবহনে চাহিদামত টিকিট ও আসন বরাদ্দ রাখা।

এনবিআর’এর প্রস্তাবে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত হারের চেয়ে এক শতাংশ কম সুদে ঋণ প্রদান, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ে বিশেষ ছাড় দেয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা প্রদানে সুপারিশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছর থেকে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করছে এমন প্রত্যয়ন পত্র এনবিআর থেকে সংগ্রহ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এনবিআরের এ প্রত্যয়ন পত্রের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিস বরাবর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা প্রদানে সুপারিশ পত্র প্রদান করবে। যা সংশ্লিষ্ট ভিসা অফিসে জমা দিতে হবে।

নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিকে চাকরি পেতে এনবিআর থেকে অর্থমন্ত্রী স্বাক্ষরিত বিশেষ প্রত্যয়ন পত্র দেয়ার কথাও প্রস্তাবে বলা হয়েছে। যা প্রর্দশনে সরকারী চাকরি পেতে বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

বর্তমানে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাজস্ব (ট্যাক্স) কার্ড প্রদান করে থাকে এনবিআর। এসব রাজস্ব কার্ডকে সিআইপি (বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি) সমমান মর্যাদা প্রদানে এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান এর আগেই অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আগের এ প্রস্তাব সাম্প্রতিক পাঠানো সুপারিশমালায় অর্ন্তভূক্ত করে বলা হয়, রাজস্ব কার্ডধারীদের সিআইপি কার্ডধারীর সমান মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। সিআইপি কার্ডধারীদের মত বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ, গণপরিবহণে প্রথম শ্রেণীর আসন বরাদ্দ, সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে বিদেশ ভ্রমণের এবং সরকারি নীতি নির্ধারকদের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে বৈঠক করার সুযোগ দেয়ার সুপারিশও করে এনবিআর।

এসব প্রস্তাবসহ এনবিআর থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ আছে, নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে রাজস্ব প্রদানে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে। বিশেষ সুবিধা পেতে অনেকে নিজ উদ্যোগে রাজস্ব প্রদানে এগিয়ে আসবেন। বিশেষ করে নতুন করদাতা (তরুণ) ও নতুন প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে আগ্রহী হবে। রাজস্ব ফাঁকিবাজরা সুবিধা বঞ্চিত হতে থাকলে এক সময় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কিংবা কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে পরিচালনার স্বার্থে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানে বাধ্য হবে। একই সাথে রাজস্ব খেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা পাওয়ার পরও রাজস্ব ফাঁকি দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের মাধ্যমে দ্রুত শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করে এনবিআর। সকল মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এসব রাজস্ব ফাঁকিবাজদের নাম, ঠিকানা এবং অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখের প্রস্তাব করে।

এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধকারীদের বিভিন্ন সুবিধা এবং সম্মান দেয়া হয়। আর রাজস্ব খেলাপিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়। তাদের নাম ঠিকানাসহ বিস্তারিত সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধকারীরা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের অংশীদার। অন্য দেশ রাজস্ব পরিশোধকারীদের বিশেষ সুবিধা ও সম্মান দিতে পারলে আমরা কেন পারব না। তাছাড়া রাজস্ব ফাঁকিবাজরা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। সঠিকভাবে আইনের শাসন না হলে সৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রাজস্ব প্রদানে উৎসাহিত হবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘এসব সুবিধা দেয়া হলে বাংলাদেশের কর সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কর দাতার সংখ্যা ১১লাখ থেকে ৫০লাখে আসতে সময় লাগবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।’

রাজস্ব পরিশোধকারীদের কি ধরনের সুবিধা দেয়া উচিত তা এনবিআর’এর আয়কর, শুল্ক ও মূসক (মূল্য সংযোজন কর) বা ভ্যাট (ভেলু এডেড ট্যাক্স) শাখা পৃথকভাবে প্রস্তাব তৈরী করে এনবিআর চেয়ারম্যানের দপ্তরে জমা দেয়। এসব প্রস্তাব নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে তিন শাখার সদস্যরা চূড়ান্ত প্রস্তাব তৈরী করেন।

এই বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদান করে তাদের ট্যাক্স কার্ড দিয়ে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু অল্প আয়ের নিয়মিত করদাতাদের ভাগ্যে এই সম্মান জোটে না। এছাড়া সাধারণ মানুষদের অনেকে প্রশ্ন তোলেন নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করে আমি কি পাচ্ছি! নিয়মিত রাজস্ব প্রদানকারী সাধারণ আয়ের একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করা হলে তারা অবশ্যই রাজস্ব প্রদানে এগিয়ে আসবে। এতে অল্প সময়ে করদাতার সংখ্যা ও রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আমার মনে হয় এনবিআর’এর এই প্রস্তাব সরকারের বিবেচনা করা উচিত।

প্রসঙ্গত, চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থ বছরে বর্তমান কর দাতা ১১লাখ থেকে ন্যূনতম আরও ৩ লাখ বাড়িয়ে ১৪ লাখে উন্নীত করতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্দেশ দিয়েছেন। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও করদাতার সংখ্যা বাড়াতে এনবিআর তাই বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করছে।



মন্তব্য চালু নেই