নীরবতা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

আমরা কোলাহলপূর্ণ ও বিক্ষিপ্ত পৃথিবীতে বাস করি যেখানে নীরবতা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে। যা আমাদের শরীরের উপর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শব্দ দূষণকে “আধুনিক প্লেগ” নামে অবিহিত করেছে এবং বলা হয়েছে যে, “পরিবেশগত কোলাহল জনগণের স্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে যার অকাট্য প্রমাণ আছে”।

আমরা কান দিয়ে ক্রমাগত বিভিন্ন ধরণের শব্দ শুনছি যেমন- গান শোনা, টিভি দেখা ও খবর শোনা এবং আমরা নিজেরাই বিভিন্ন ধরণের শব্দ তৈরি করছি অনবরত। একটু চিন্তা করে দেখুনতো দিনের কতটুকু সময় আপনি নীরব থাকেন? এর উত্তর সম্ভবত খুব সময় হবে। আমাদের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ ক্রমশই কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠছে। নীরবতা আপনার মস্তিষ্কের জন্য কতটা উপকারি তা জেনে নিই চলুন।

১। স্ট্রেস ও টেনশন মুক্ত হতে সাহায্য করে

উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ নার্স ও সমাজ কর্মী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল একবার লিখেছিলেন যে, “অপ্রয়োজনীয় শব্দ যত্নের নিষ্ঠুর অনুপস্থিতি, যা সুস্থ বা অসুস্থ উভয়ের জন্যই নির্যাতনের সমান”। নাইটিংগেল বলেন, অপ্রয়োজনীয় শব্দের ফলে রোগীর নিরাময় দেরিতে হয়, ঘুম কমে যায় ও যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়। শব্দ দূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কানের পাশাপাশি সার্বিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতিসাধন করে করে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, উচ্চমাত্রার শব্দ মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশকে সক্রিয় করে তোলে ফলে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোল নিঃসৃত হয় এবং স্ট্রেস বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় আর দেখা গেছে যে নীরবতা ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করে থাকে। অর্থাৎ নীরবতা শরীর ও মস্তিস্ক থেকে টেনশন দূর করে। ২০০৬ সালে হার্ট নামক জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন মোতাবেক জানা যায় যে, রক্তচাপ ও মস্তিস্কের রক্ত সংবহনের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে ২ মিনিটের নীরবতা গান শুনার চেয়েও বেশি রিলাক্সিং হতে পারে।

২। নীরবতা মানসিক সম্পদকে পরিপূর্ণ করে

প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটা কোণ থেকেই আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর চাপ আসছে। আমরা যখন এই ধ্বনিতরঙ্গের বিঘ্ন থেকে দূরে যেতে পারি তখনই আমাদের মস্তিস্কের মনোযোগ কেন্দ্র নিজেকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ পায়। আধুনিক জীবনের বিরামহীন দাবী (চিন্তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধান) আমাদের মস্তিস্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের উপর বাঁধা সৃষ্টি করে। এর ফলে মনোযোগ হ্রাস পেতে থাকে। তাই আমরা বিভ্রান্ত ও মানসিকভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে পরি। তাই আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা, সমস্যার সমাধান করা ও নতুন ধারণা সৃষ্টিতে সংগ্রাম করতে হয়। মনোযোগ পুনরুদ্ধার মতবাদ অনুযায়ী, অনুকূল পরিবেশে মস্তিস্ক তার সসীম জ্ঞান পুনরুদ্ধার করে নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যা নীরবতার কথা। আপনি যদি একা একা কিছুক্ষণ হাঁটেন তাহলে শান্ত স্তব্ধতা খুঁজে পাবেন।

৩। নীরবতা মস্তিস্কের ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ককে নাড়া দেয়

মস্তিস্কের ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক কাজ করে তখনই যখন “স্ব-উৎপন্ন চেতনা” যেমন- দিবাস্বপ্ন দেখা, ধ্যান করা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনা করা ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয়। যখন মস্তিষ্ক অলস থাকে তখন চিন্তা, আবেগ, স্মৃতি ও ধারণা মনকে নাড়া দেয়। এই ধরণের নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে অভিজ্ঞতার অর্থ বুঝতে পারা, অন্যদের সাথে নিজের মতামত শেয়ার করতে পারা, সৃজনশীল হওয়া এবং মানসিক ও আবেগের প্রতিফলন হয়। ডিফল্ট মোড আমাদেরকে গভীরভাবে ও সৃজনশীলভাবে ভাবতে সাহায্য করে। হারমান মেনভিল লিখেছিলেন, “সকল অন্তর্নিহিত ও আবেগপূর্ব সিদ্ধান্ত নীরবতার অংশগ্রহণে হয়ে থাকে”।

৪। নীরবতা মস্তিস্কের কোষকে পুনর্জীবিত করে

মস্তিস্কের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে নীরবতা। ২০১৩ সালের ব্রেইন জার্নালে প্রকাশিত ইঁদুরের উপর করা এই গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায় যে, দৈনিক ২ ঘন্টার নীরবতায় মস্তিস্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে নতুন কোষ উৎপন্ন হয়। মস্তিস্কের এই অঞ্চলটি শিক্ষা, স্মৃতি ও আবেগের সাথে সংযুক্ত। নীরবতা বিষণ্ণতা ও আলঝেইমার্স এর ঔষধ হিসেবে কাজ করে।



মন্তব্য চালু নেই