পদ্মা সেতু দুর্নীতি: কানাডার আদালতের রায় নিয়ে বার্গম্যানের প্রশ্ন

গত শুক্রবার কানাডার একটি আদালত পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা থেকে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পেতে ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু অভিযোগের পক্ষে জোড়ালো প্রমাণ না থাকায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে কানাডার আদালত ওই তিন কর্মকর্তাকে বেকসুর খালাস দেন।

পদ্মা সেতুর কাজ পেতে ঘুষের যে অভিযোগ উঠেছিল তাকে অনুমানভিত্তিক ও গুজব বলে মামলার কাজ এগিয়ে না নেয়ার কথা জানিয়েছেন দেশটির আদালত। কানাডার আদালতের রায়ে কর্মকর্তারা যে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আসলেই কী দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন কর্মকর্তারা?

২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার রায় নিয়ে ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ারে ডেভিড বার্গম্যান এক প্রতিবেদন লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিশ্বব্যাংক ওই চুক্তি বাতিল করেছিল। কিন্তু সেখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি উল্লেখ করে ওই সময় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তকে অপ্রয়োজনীয় বলে জানায়।

এরপর নিজস্ব অর্থায়নে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সংযোগ স্থাপনের জন্য এ সেতু তৈরির কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে এ সেতু নির্মাণাধীন।

বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী ও এ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মনগড়া গল্প ও গুজবের ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছিল। এটা স্পষ্টভাবে আমাদের ক্ষতি করেছে। এখন আমরা আমাদের মর্যাদা ফিরে পেয়েছি।

ডেভিড বার্গম্যানের সংশয়

কানাডার আদালতের আদেশের পরিসমাপ্তির জবাবে রাজনীতিকদের মন্তব্যের যথার্থতা বিবেচনার জন্য আদালতের ওই মামলা ও বিশ্বব্যাংকের তদন্তের ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে ডেভিড বার্গম্যান মন্তব্য করেছেন। কানাডার আদালত ওই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাননি।

এক. এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কানাডীয় কর্মকর্তা কানাডার ওই আদালতে বিচারাধীন ছিলেন। এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, ওই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি। অথবা এমনও নয় যে এই তিনজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ ছিল না।

এর অর্থ হচ্ছে, এটি ছিল বিচারকদের মতো। ওয়্যার টেপ (ফোনে আড়িপাতার রেকর্ড) প্রমাণ ছাড়া তারা চিন্তা করেনি যে, কোনো আইনে আদালত অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন। ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, এসএনসির এই তিন কর্মকর্তা অপরাধী ছিল এবং তারা অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

দুই. আদালত রুল দেননি যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ‘কল্পকাহিনী’ ও ‘গুজব’র ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেছেন, ওই তিন ব্যক্তির ফোন রেকর্ড আদালতের কাছে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত ছিল। ২০১১ সালে ফোনে আড়িপাতা তথ্য ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। বিচারক রায়ে বলেছেন, এই বিশেষ আবেদন করা হয়েছিল ছয় বছর আগে গাল-গল্প ও গুজবের ওপর ভিত্তি করে।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, বিশেষ এ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা অথবা ওই প্রকল্পে সাধারণ দুর্নীতির অভিযোগকে গুজব বা ভিত্তিহীন বলেননি বিচারক।

তিন. ঘুষের চেষ্টার মামলা সর্বদা প্রমাণ করা কঠিন। বিশ্বব্যাংক নিজেদের অভিযোগের তদন্ত বন্ধ করে দেয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হাজির করা হঠিন হয়ে যায়। কাজ পেতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার চেষ্টা অথবা ঘুষ দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেই ইস্যুতেই মামলা ঝুলে ছিল; কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার অভিযোগে নয়।

চার. ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বাংলাদেশ সরকার অস্বীকার করায় মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে এবং এই ইস্যুটি জাতীয় গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তের পর যথেষ্ঠ প্রমাণের অভাবে মামলা বাতিল করেছে।

পাঁচ. বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রমাণ দিয়েছিল তারা। ২০১২ সালের জুনে এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক জানায়, দুটি তদন্তের পর তারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল।

ছয়. কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল মেনে নিয়ে এসএনসি-লাভালিন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি নিষ্পত্তি চুক্তি করতে চেয়েছিল। পরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কাজে ১০ বছরের জন্য এসএনসি-লাভালিনকে নিষিদ্ধ করে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা।

সাত. ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, কোম্পানির কর্মকর্তাদের খালাস দিয়েছেন আদালত। কিন্তু বিশ্বব্যাংক কোম্পানিটির ওপর ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও কোনো ধরনের প্রতিবাদ জানায়নি এসএনসি।

আট. পদ্মা সেতুর ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বিশ্বব্যাংক তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করেনি। বিশ্বব্যাংক চারটি তদন্তের সময় সন্দেহভাজন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এ দাবি বাস্তবায়নে সরকারের অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করা হয়।



মন্তব্য চালু নেই