পবা-মোহনপুর নৌকার বিজয় বেশী হলেও হেরেছে নেতারা, ঠকেছে ভোটার

সরকার দুলাল মাহবুব, রাজশাহী থেকে : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সারা দেশের মত রাজশাহীর পবা ও মোহনপুরে চেয়ারম্যান পদে নৌকার বিজয় বেশী। তবে মনোনয়ন বাণিজ্য ও প্রার্থী মনোনীত না হওয়ায় নৌকার সম্মান কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন হয়েছে।

দেশের আর একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ধানের শীষও লুন্ঠিত হয়েছে নেতাদের কারণেই। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দ এবং বিএনপি’র মহানগর নেতৃবৃন্দকে দুষছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সার্বিকভাবে নৌকা বিজয়ী হলেও হেরেছেন রাজশাহী জেলা নেতৃবৃন্দ।

আবার অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, নৌকার নিরঙ্কুস বিজয় না হওয়ায় অন্যসব বিজয়ীরা সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে বরাদ্দ পেয়েও না পাওয়ার অজুহাতে উন্নয়ন কাজ করবেন না। ফলে জনগণ সেবা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণায় শেষ পর্যন্ত সঠিক হলো। জেলার পবা ও মোহনপুরের ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪জুন ৬ষ্ঠ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। মোহনপুর উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩ এবং বিএনপি’র ২ জন প্রার্থী বিজয়ী হয়। এখানে একটি ইউনিয়নে আওয়ামী বিদ্রোহী বিজয়ী হয়েছেন।

পবা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ২টি আওয়ামী লীগ ও ২ টি বিএনপি এবং ৩টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। যার মধ্যে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী স্বতন্ত্র ২ ও জামায়াত স্বতন্ত্র ১টিতে বিজয়ী হয়েছেন।

একটি সুত্রে জানা গেছে, এক সময় রাজশাহীর মাটি বিএনপির ঘাটি বলে বীরদর্পে বক্তব্য রাখতেন নেতারা। প্রতিহিংসার নেতৃত্বের কারণে অনেক আগেই ঘাটির মাটিতে কম্পন শুরু হয়েছে যা আজও থামেনি।

এবারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একদিকে যোগ হয় মনোনয়ন বাণিজ্য এবং অন্যদিকে মহানগর বিএনপির বিএনপির নেতৃত্বে প্রার্থী ইমেজে ভাটা। আর আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দের অনেকেই নৌকা ভাঙ্গিয়ে আখের গোছানোর অভিযোগ করেন মনোনয়ন বঞ্চিতরা।

উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নানান নাটকীয়তায় ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। উভয় দলের তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের পছন্দের প্রার্থীকে বাতিল করে “শুভঙ্করের ফাঁকি ও ধোঁকা” দিয়ে স্থানীয়, জেলার ও বিএনপির মহানগরের গ্রুপিং-এ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত নাই এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। যে কারণে বিজয়ী প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিও হতে পারেন নি অনেকে। আবার কম ইমেজের বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য উভয় দলের প্রার্থীরাও ডুবেছেন।

রাজনৈতিক ও ভোট বিশ্লেষকদের দৃষ্টি ও আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু ছিল পবা ও মোহনপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। আ’লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তৃণমুলের ভোটাভোটি হলেও অনেকাংশে এই পদ্ধতি ও তৃণমুলকে উপেক্ষা করে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল।

আবার দলের যে কোনদিনও সদস্য ছিলেন না এমন অপরিচিত প্রার্থীকেও মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এমন অবস্থায় চরম হতাশা গ্রস্ত তৃনমুল নেতা-কর্মীরা ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে। নির্বাচনী লক্ষ্যে বিদ্রোহীরা চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচনী মাঠে ছিলেন। আক্রোস আর প্রতিহিংসার আগুন এবং নেতৃত্ব ধরে রাখতেই অনেক বিদ্রোহী নির্বাচন থেকে পিছু হটেননি।

বিশেষ করে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতিক থাকলে প্রতিটি ইউনয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর মধ্যেই। কিন্তু তা হয়নি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা অনেক ভাল করেছে। অনুসন্ধানে বিএনপির একটি সুত্র বলছে, মনোনয়ন বাণিজ্যই বিএনপির অনেকটা ভরাডুবি হয়েছে।

পক্ষান্তরে পবা উপজেলায় আওয়ামী লীগও ভাল করতে পারেনি। কোন কোন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দের মনোনয়ন বাণিজ্যকেই দুষছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ। ফলে নিজেদের প্রতিহিংসার কারণেই প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকা বিজয়ী হতে পারে নি। অনেকেই বলছেন সার্বিকভাবে নৌকা বিজয়ী হলেও হেরেছেন রাজশাহী জেলা নেতৃবৃন্দ।

উপজেলার পারিলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী সাইফুল বারী ভুলু ৬ হাজার ৬৭৯ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকা প্রতিকের ফাহিমা বেগম পেয়েছেন ৬ হাজার ১২১ ভোট। তৃণমুল পর্যায়ে ফাহিমা বেগম সদস্য ভোট পেয়েছিলেন ২। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাকে দেয়া হয়েছিল বলে একটি সুত্র জানায়। তবে এই ইউনিয়নে পীড়াদায়ক ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর। বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হলেও প্রার্থী মনোপুত না হওয়ায় এবং বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এ অবস্থা হয়েছে।

হড়গ্রামে জামায়াতের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ৫ হাজার ৬৫৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি স্বতন্ত্র প্রার্থী পেয়েছেন বিএনপি বিদ্রোহী ৩ হাজার ৯৪৬ ভোট। আর ধানের শীষ পায় ৩ হাজার ৯২০। এখানে নৌকা পায় ৩ হাজার ৭০১। এখানে নৌকাকে বিজয়ী হতে দেয়নি ১৪ দলের ওয়ার্কার্স পাটির প্রার্থী। এই প্রার্থী পেয়েছেন ২ হাজার ৩১০ ভোট। ওই ইউনিয়নের অনেক নিন্দুক বলছেন, শরীক দল বাদ দিয়ে ঐ পার্টির অনেক নেতা পার্লামেন্ট নির্বাচনেও এত ভোট পান না।

হুজুরিপাড়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আকতার ফারুক ৪ হাজার ১৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আরেক আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দেওয়ান রেজাউল করিম পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৪৯ ভোট। নৌকাতো পারেইনি প্রার্থী মনোনয়নে অদুরদর্শীতার জন্য ধানের শীষ চতুর্থ।

দামকুড়া ইউনিয়নে ১০১ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী আব্দুস সালাম ৩ হাজার ৩৭১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ মনোনিত রফিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৩ হাজার ২৭০ ভোট। এখানে পবা উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের ভাতিজা রেজাউল হক আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হয়ে পেয়েছেন ১ হাজার ৬০৪ ভোট। আওয়ামী লীগ একাট্টা থাকলে নৌকার বিজয় এখানে সুনিশ্চিত ছিল।

বড়গাছিতে বিএনপি প্রার্থী সোহেল রানা ১০ হাজার ৩৭৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এমদাদুল হক ৮ হাজার ৬২৮ ভোট পেয়েছেন। এমদাদুল হক বিগত পাঁচ বছর থেকে মাঠে ছিলেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগ-এর বলি হয়েছিলেন তিনি। এখানে নৌকা প্রতিক পেয়েছেন ৪ হাজার ৬৭। এখানে দু’জনের যেকোন একজন থাকলে নৌকার প্রার্থীই বিজয়ী হতো।

এদিকে মোহনপুরের জাহানাবাদ ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এমাজ উদ্দিন খাঁন ৮ হাজার ১৭৮ পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামীলীগ হতে নৌকা প্রতীক নিয়ে হযরত আলী ৬ হাজার ১১৯ ভোট পেয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী পেয়েছে ২ হাজার ৯৬৫ ভোট। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী না থাকলে নৌকায় বিজয়ী হতো।

একদিকে প্রার্থী মনোনয়নে অদুরদর্শীতা, বাণিজ্য ও দলীয় প্রতিহিংসায় জ্বলেছে অনেকেই। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জেলা ও মহানগর নেতারা এ সমস্ত অভিযোগ মানতে নারাজ।



মন্তব্য চালু নেই