পর্যটকের কাছে বিক্রি করা হয় কন্যাশিশুদের!

মুনিরা বেগম নামে বার বছর বয়সী মেয়েকে ৭০ বছর বয়সী ওমানী পর্যটকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার মা। মেয়েটির সাথে মাস দুয়েক বসবাস করে ওমানে চলে যায় সে পর্যটক। ওদিকে গর্ভবতী হয়ে পড়েন মুনিরা। বার বছর বয়সী শিশু গর্ভবতী হন এবং একটি কন্যার জন্ম দেন। স্রেফ ফোনে ডিভোর্স দিয়ে তথাকথিত বিয়ের ইতি টানেন সেই ওমানী বুড়ো। তারপর কঠিন দিন নেমে আসে মুনিরার জীবনে। বার্তা সংস্থা সিএনএন এর একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে হায়দরাবাদের অন্ধকার জগতের চালচিত্র। কীভাবে নারী পাচারকারী, দালাল, মোল্লা, শিশু সেক্সে আসক্ত পর্যটকদের এই চক্রটি কাজ করে যাচ্ছে।

পুরনো হায়দরাবাদ শহরে মুনিরা বেগমের মতো এরকম শত শত কাহিনী আছে বলে জানা যায় যেখানে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কিছুদিনের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেটাকে বিয়ে হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য একজন মোল্লা প্রস্তুত থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট কয়েকদিন বা মাস পড়ে সেই পর্যটক কিছু টাকা দিয়ে সেখান থেকে চলে যান। যাওয়ার আগে আবার ডিভোর্স ও দিয়ে যান। এ সবগুলো পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন দালাল, মোল্লা ও খদ্দের প্রস্তুত থাকে।

মুনিরা বেগমের ভাগ্যেও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। বর্তমানে তার বয়স উনিশ। সাত বছর আগে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় ৭০ বছর বয়সী এক পুরুষের কাছে। জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তার সাথে। তখন মুনিরার বয়স ১২।

মুনিরা সে ওমানী পর্যটকের হাতে আটক ছিলেন দুই মাসের মতো। সে দু’মাস মুনিরাকে ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। তার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করা হতো। কোন ধরণের প্রতিবাদ করার চেষ্টা হলে সে লোকটি বলতো: ‘আমি তোমাকে কিনেছি। আমি যা চাই তাই করতে পারবো। তোমার বাবা-মাকে পয়সা দিয়েছি। আমার যতদিন ইচ্ছা তোমাকে ব্যবহার করতে পারবো। তোমার মুখ বন্ধ রাখো।’

বার বছর বয়সী মুনিরার কাছে তার তথাকথিত স্বামীর সাথে সময় ছিল ভয়ানক কষ্টের। প্রতিরাতে সে ৭০ বছর বয়সী পুরুষের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতেন মুনিরা। তার কঠিন সে দিনগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে মুনিরা বলেন, ‘আমার লেখাপড়া ছিল না। আমার সাথে কি হচ্ছে সেটা আসলে বুঝে উঠতে পারিনি। আমি আসলে শিশু ছিলাম। আমি বাহিরে যেতে চাইলে আমাকে ঘরের ভেতরে তালা দিয়ে যেতো। আবার ফিরে এসে আমার সাথে নির্যাতন করতো।’

মুনিরা বেগম একটি কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন। জোর করে বিয়ে দেওয়া সেই ওমানী পুরুষের ঔরসেই সে মেয়ের জন্ম হয়। সত্তর বছর বয়সী সেই ওমানী পর্যটকের সাথে মাস দুয়েক কাটানোর পরপরই সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। কিন্তু হায়দরাবাদ ছেড়ে যাওয়ার পর ফোনে ডিভোর্সের কথা জানায় ওমানী পুরুষটি। তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিল মুনিরা। এত কষ্ট পেয়েছিল যে হাতের শিরা কেটে দিয়ে মরার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু শাহীন নামে একটি এনজিও এগিয়ে আসে তাদের মতো মেয়েদের সহায়তায়। জামিলা নিশাত নামে একজন নারী সমাজকর্মী সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ বছর আগে। জামিলা নিশাত জানান তার সংস্থাটি অন্তত ১০০ জন মেয়েকে সরাসরি সেবা প্রদান করে আসছে। প্রায় ১ হাজার মেয়ে ও নারীকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে আসছে।

মুনিরা বেগম বর্তমানে শাহীন এর আওতায় আছেন। মুনিরাদের মতো মেয়েদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই কাজ, মেহেদী লাগানোর কাজ ও কম্পিউটার ব্যবহার শেখাচ্ছে শাহীন।

শাহীন-এর মাধ্যমে পুলিশের কাছে একটি মামলা দায়ের করে মুনিরা। সত্তর বছর বয়সী ওমানী পর্যটকের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য যে দালাল হিসেবে কাজ করেছিল তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

তার কঠিন অভিজ্ঞতাগুলোর কথা বলতে গিয়ে সে বলে, ‘আমি যে ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমি চাইনা অন্য কোন মেয়ে সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাক।’

মুনিরা সে সময় খুবই ছোট্ট ছিলেন। মাত্র বার বছর বয়সী মেয়ে। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার সামর্থ্য হওয়ার আগেই অভিজ্ঞতা হয় কঠিন জগতের। কিন্তু একজন মা কিভাবে বেঁচে দিতে পারেন তার মেয়েকে? মুনিরার মায়ের কাছে অবশ্য এর জবাব রয়েছে। তিনি জানান কিভাবে পাঁচ সদস্যের পরিবারটি নিয়ে একটি ছোট্ট রুমে বসবাস করতেন হায়দরাবাদের সবচেয়ে দরিদ্র একটি এলাকায়। তার স্বামী মদ পান করতো এবং সংসারে কোন টাকা পয়সা দিতো না। মনে করেছিলেন মুনিরাকে বিয়ে দিলে মুনিরার জীবনে সুখ আসবে আর তাদের পরিবারে আসবে কিছু অর্থ।

কেন নিজের মেয়েকে সেই বুড়ো ওমানী পুরুষের কাছে বিক্রি করেছিলেন তার জবাবে মুনিরার মা জানান, ‘আমরা ভেবেছিলাম এটা করে আমরা একটা ছোট্ট ঘর করতে পারবো এবং সেখানে বসবাস করতে পারবো। আমাদের জীবন ও আমার মেয়ের জীবনে ভালো কিছু আসবে। সেই ভেবে আমরা এমনটা করেছিলাম।’

সূত্র: সিএনএন



মন্তব্য চালু নেই