পলাশ গাছ হয়ে ওই উঁচুতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ

জন্ম ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে বয়স তার মাত্র তিন বছর ছয় দিন। তিনশ বছর গড় আয়ু যে গাছের, তিন বছর তার কাছে কিছুই না। সেই ‘শিশু’ গাছের মাঝেই যেন বাবার ছায়া দেখতে পান শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তিন বছর আগে পলাশ গাছটি লাগিয়েছিলেন তিনি। এলাকাটির নাম দেয়া হয় ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্ত্বর’। তখন মোটে তিনটি পাতা ছিল গাছটির গায়ে। আর এখন গাছটি ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

ধীরে ধীরে সবার চোখের সামনে গাছের রূপ নিয়ে আলতাফ মাহমুদ আবার বড় হচ্ছেন বলে মনে করেন শাওন মাহমুদ।

বাবার স্মরণে গাছ কেন? একুশের গানের অমর সুরকারের কন্যা বলেন: বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ, স্মারক বা স্মৃতিফলক থাকে। একটা সময় দেখলাম, বাবার স্মরণে এমন কোন কিছুই নেই যা দেখে আমার মৃত্যুর পরও পরের প্রজন্ম তাকে মনে রাখতে পারে। কবর বা স্মৃতিফলক তো মানুষ দেখতে পারে। আমার বাবার তো সেটাও নেই।

‘একটা জার্নালে পড়েছিলাম, প্রিয়জন, বিশেষ করে মৃত প্রিয়জনের স্মরণে তারা গাছ লাগায়, বেঞ্চ করে। সেটা পড়েই কেন যেন আমার মনে হলো আমার বাবার নামে একটা দীর্ঘজীবী গাছ লাগাই। গাছ হয়ে বাঁচুক আলতাফ মাহমুদ।’

এ কারণেই খুঁজতে খুঁজতে পলাশ গাছকেই বাবা আলতাফ মাহমুদের স্মারক হিসেবে বেছে নেন শাওন মাহমুদ। একেকটি পলাশ গাছ প্রায় ৩শ’ বছর পর্যন্ত বাঁচে।

স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভের বদলে গাছকে হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে শাওন বলেন: সে সবের তুলনায় একটি গাছ অনেক বেশি প্রাণবন্ত। গাছের জীবন আছে। সময়ের সাথে সাথে তা বড় হয়, তাতে পরিবর্তন আসে।

‘গাছটিকে সবাই বড় হতে দেখবে। যখন আমি থাকব না, গাছটিতে যখন লাল লাল পলাশ ফুল ফুটবে, তখন দেখে মনে হবে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আলতাফ মাহমুদ বেড়ে উঠছেন, উনি আছেন আমাদের সঙ্গে।’

সোমবার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ধোয়া-মোছা ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে বেশ ক’দিন ধরে। বিভিন্ন জায়গায় মাইক লাগানো হচ্ছে। এসব কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত পলাশ গাছটির সবচেয়ে উঁচু ডালটি ভেঙ্গে গেছে বলে জানান শাওন।

ক’দিন আগে শহীদ আলতাফ মাহমুদ চত্ত্বরে গিয়ে ভাঙ্গা ডালটি দেখে বেশ মন খারাপ করেন তিনি।

ফেসবুকে একটি পোস্টে দুঃখ করে শাওন মাহমুদ লিখেন, ‘হঠাৎ চোখে পড়ল গাছটার সবচেয়ে উঁচু নতুন ডালটা ভেঙ্গে নেতিয়ে আছে একদিকে। মনে হয়েছিল কেউ বাবার ঘাড় ভেঙ্গে ফেলেছে। টিপু যথারীতি সান্ত্বনার সুরে বলে উঠল, কাজ করছে ওরা, হয়তো মইয়ের আঘাতে এমন হয়েছে, আবার ডাল বের হবে, মন খারাপ করতে নেই।’

মন খারাপ করলেও সেটাকে শুধু দুর্ঘটনা উল্লেখ করে শাওন মাহমুদ বলেন, গাছটির প্রতি আশপাশের মানুষের একটা মায়া তৈরি হয়েছে।

‘গাছটি লাগানোর সময়ই উপস্থিত সাংবাদিকসহ অন্যরা আশপাশের মানুষকে বুঝিয়ে এসেছিলেন, এটি শুধু একটি গাছ নয়। এটি ভিন্ন কিছু। সেই প্রথম থেকেই এলাকার লোকেরা গাছটির অনেক যত্ন করেছেন। পানি দিয়েছেন। এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, গত তিন বছরে গাছটির একটা জিনিসও জায়গা থেকে সরেনি।’

ফেসবুকের ইনবক্সে ফেব্রুয়ারি ছাড়াও অন্যান্য সময়ে অনেক ছবি আর মেসেজ পান শাওন মাহমুদ। বলেন, ‘অনেকেই জানান, আমি গাছটায় পানি দিয়ে এসেছি, সেখানে বসে ছিলাম। প্রথম দিকে যাওয়া-আসার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও গাছটায় নিয়মিত পানি দিতেন। এখনো অনেকে জানে না গাছটা সম্পর্কে। ওভাবে প্রচার হয়নি আলতাফ মাহমুদ চত্ত্বরের কথা। মাত্র তিনটা বছরই তো হয়েছে। ধীরে ধীরে আরও অনেক মানুষ এটা সম্পর্কে জানবে।’

শাওনের স্বপ্ন – এক সময় পলাশ গাছটা অনেক বড় হবে। অনেক মানুষ তার নিচে এসে বসে গল্প করবে। ছোট ছোট বাচ্চারা পলাশ ফুল ফোটা দেখবে, আর জানবে কিংবদন্তী সুরকার আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার গেরিলা বাহিনীর অন্যতম আশ্রয় হয়েছিলেন। গেরিলাদের অস্ত্রভাণ্ডারও নিজের বাসায় লুকিয়ে রাখতেন তিনি। গানের সুর করে পাঠাতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। একাত্তরের আগস্ট মাসের শেষদিকে ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী। তাদের চরম নির্যাতনে শহীদ হন তিনি। কিন্তু, তার মরদেহও পায়নি আলতাফ মাহমুদের পরিবার।-চ্যানেল আই অনলাইন



মন্তব্য চালু নেই