পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এখনো চলে নবাবি ইফতার

পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগের ইমামবাড়ায় এখনো চলে নবাবি ইফতার। রমজান মাস পড়তেই লালবাগের এই ইমামবাড়ার ভেতরে শুরু হয়ে যায় তৎপরতা। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

এই ইমামবাড়ার ভেতরে জ্বলছে তিনটি বিশালাকার উনুন। কাঠের আগুন থেকে দক্ষতার সঙ্গে রুটি বের করে আনছেন রাঁধুনিরা। জমা হয় রাশি রাশি রুটির পাহাড়। সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ফল ছাড়াতে ব্যস্ত নারী কর্মীদের দুই হাত। আর পুরো ব্যাপারটাই তদারকি করছেন ইমামবাড়ার সহকারী সুপার কামবার আলী।

রোজার মাস উপলক্ষে এখন প্রতিদিন চলছে এই কর্মযজ্ঞ। ইফতারের সময়ের আগেই এসব খাবার চলে যায় লালবাগের ইমামবাড়া থেকে ওয়াসেফ মঞ্জিল বা নিউ প্যালেসের পাশের চক মসজিদে। সেখানেই চলে এসব খাবার দিয়ে নবাবি ইফতার।

যাবতীয় খাবার প্লেটে করে সাজিয়ে দেওয়া হয় মসজিদে আসা রোজদার, অর্থাৎ রমজান মাসে এক মাস ধরে রোজা রাখা ব্যক্তিদের জন্য। এভাবেই মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। নবাবি আমল থেকে আজ পর্যন্ত ঐতিহ্যপূর্ণ এই নিয়মে কোনোদিন ছেদ পড়েনি।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে এই নবাবি ইফতার। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার মুর্শিদাবাদের লালবাগের এই ইমামবাড়া নিজেদের অধীনে নেয়। কিন্তু মুর্শিদাবাদের নবাব বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে ইফতারে আসা ব্যক্তিদের খাওয়ানোর নিয়মটা বন্ধ করা হয়নি।

শোনা যায়, ১৮৪৭ সালে ওলন্দাজি ও চিনা টালি দিয়ে প্রায় সাত লাখ রুপি খরচ করে ফেরদুনজা নামের এক ইমামবাড়া নির্মাণ করেন। ফেরদুনজার ছেলে প্রথম নবাব বাগাদুর সৈয়দ হাসান আলী মির্জা।

নবাবদের বর্তমান বংশধর ছোট নবাব বলেন, ‘হাসান আলী মির্জার ছেলে সৈয়দ ওয়াসফ আলী মির্জা আমার নানাজি। তিনি পড়াশোনা করার জন্য প্রায় ১০ বছর লন্ডনে ছিলেন। সেই সময় নানাজির অবর্তমানে তাঁর নামে রোজার সময় মাসভর ইফতারে এই খাওয়ানোর নিয়ম চালু করেন হাসান আলী মির্জা। এরপর তিনি মারা যাওয়ার পর ওয়াসেফ আলী মির্জা দ্বিতীয় নবাব বাহাদুর হন। সেই সময় অনেকে এই নিয়ম বন্ধ করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেন।’

‘কিন্তু লন্ডন থেকে দেশে ফিরে নিজে রোজা করলেও তিনি তাঁর বাবার নিয়ম বন্ধ হতে দেননি। যত দিন বেঁচে ছিলেন, এই নিয়ম চালিয়ে গেছেন। আজও সেই নিয়ম মেনে চলে নবাবি ইফতার। তবে আগের মতো ইফতারের খাবারে জৌলুস এখন আর নেই।’

ছোট নবাব জানান, সে সময় প্রতিদিন ইফতারে বিরিয়ানি দেওয়া হতো। একেক দিন একেক রকমের বিরিয়ানি দেওয়া হতো। সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ফল পেট ভরে খেতেন রোজদাররা। আজ সেই নবাবি খানা কোথায় হারিয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে এখন তো মাসে দুদিন বিরিয়ানি দেওয়া হয়। অন্যান্য দিন রুটি-তরকারি খাওয়ানো হয় রোজদারদের। তবে আজও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবেই নিজেদের বংশের ঐতিহ্য নিয়েই চলে মুর্শিদাবাদের লালাবাগে এই নবাবি ইফতার।

আজও এই চক মসজিদে এসে নামাজ পড়েন বহু মানুষ। নামাজ শেষে ছোট নবাব নিজে রোজদারদের খাওয়ানোর তদারকি করেন।

বর্তমানে এক মাস ধরে প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন রোজদার ইফতারে অংশ নেন। তাঁদের জন্য তৈরি হয় প্রতিদিন ৬০০ নানরুটি। দেওয়া হয় পাঁচ রকমের ফল। এ ছাড়া সেহরিতে নিত্য ডাল-রুটির ব্যবস্থা করা আছে রোজার মাসে।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য তিনজন রাঁধুনি ও অন্যান্য কর্মচারী ক্লান্তিহীন খেটে চলেছেন। মুর্শিদাবদের নবাবদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাসিমুখে এই পরিশ্রমে মাথা পেতে নিয়েছেন সবাই।

আর এটা না করলে যে ছেদ পড়বে নবাবিয়ানায়। আর ঐতিহ্যবাহী মুর্শিদাবাদের নবাবি ইফতারের এই ধারা বন্ধ হোক, এটা লালবাগ তথা মুর্শিদাবাদের কোনো মানুষই চান না। হাজার হোক, নবাব দেশের বাসিন্দা তাঁরা। আর সেই দেশে থেকে নবাবি ইফতার আজও তাঁদের গর্ব, অহংকার।



মন্তব্য চালু নেই