পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার সুর

হঠাৎ করেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যেন সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত হয়েছে। এর একদিকে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি যারা সংঘর্ষের ঘটনাগুলোকে মদদ দিচ্ছে এবং অন্যদিকে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, যারা মূলত এখন ক্ষমতায়। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার করণেই হোক অথবা কৌশলগত কারণেই হোক সংঘর্ষের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ ইতোমধ্যেই দুটি সাম্প্রদায়িক দলের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। একপক্ষে আছে আঞ্জুমান আহলে সুন্নাতুল জামাত এবং অন্যদিকে আছে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা। গত সপ্তাহেই মালদা জেলার কালিচকে এই দুই দল মুখোমুখি দাড়িয়ে গিয়েছিল এবং সরকারি বাহিনী প্রয়োগ করতে হয়েছিল দাঙ্গা বন্ধ করতে।

মালদার ঘটনার ঢেউয়ের ছোয়া রাষ্ট্র পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোতেও লেগেছে এবং কোনো কারণ ছাড়াই জরুরী সতর্কতা জারি করা হয়েছে। একদল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে এবং অন্যদল পরিস্থিতি শান্ত করার নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ঝিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কারণ আগামী ২০১৬ সালেই আসলে নির্বাচন, এবং এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই ক্রমশ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

মালদা আর মুর্শিদাবাদ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অনেকদিন ধরেই প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব চলছিল। সেই দ্বন্দ্বের কারণও সেই ভোট, কারণ দুই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো মুসলিম নিয়ন্ত্রানাধীন এবং এখানে বিজেপি তাদের ভোটব্যাংক খুলতে চাইছে অনেকদিন ধরেই। অঞ্চলটিতে অসন্তোষ তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, এমন মানুষদের সেখানে হাঙ্গামা করতে দেখা যাচ্ছে যারা কেউই মূলত ওই অঞ্চলের নয়। কালিয়াচকের পুলিশ চৌকিতে যারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং একজন হিন্দু পূজারীকে আহত করেছিল তার উদ্যোক্তা ছিল মূলত আঞ্জুমান আহলে সুন্নাতুল জামাত(এএএসজে)। কয়েক মাস আগে উত্তরপ্রদেশে হিন্দু মহাসভার এক কর্মী কমলেশ তিওয়ারি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)’কে নিয়ে কটুক্তি করায় ব্লাসফেমির অভিযোগ এনে ওই দাঙ্গার ঘটনা ঘটানো হয়।

রাজ্যের অন্যতম বিরোধী দল বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া(মার্ক্সিস্ট) যেখানে একটি র‌্যালি করার জন্য অনুমতি পাচ্ছে না, এমনকি তাদের কোনো সভাও করতে দেয়া হচ্ছে না, সেখানে এএএসজে বিশাল জমায়েত করে এবং তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারপূর্বক হাঙ্গামা শুরু করে। ওই হাঙ্গামায় তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাকর্মীও জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। কারণ দাঙ্গার ঘটনায় যে নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয় তারমধ্যে ছয়জনকেই পাওয়া যায় যারা তৃণমূলত কংগ্রেস কর্মী। আর পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কর্মীদের যে থানা থেকেই বেল পাইয়ে দেয়া হয় তাতো অজানা নয়।

পশ্চিমবাংলায় এএএসজে এবং হিন্দু মহাসভা, কোনোটিই অতটা জনপ্রিয় নয়। শুধু জনপ্রিয়তা ছাড়াও অনেকাংশে এদের সদস্য সংখ্যাও খুবই কম। কিন্তু তারপরেও মালদার দাঙ্গার ঘটনা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে প্রভাব সৃষ্টি করতে পেরেছে। অবশ্য এটাই হয়তো চেয়েছিলেন রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। কারণ রাজ্যের মধ্যে যে স্থানগুলো সাম্প্রদায়িকভাবে কিছুটা স্পর্শকাতর সেসব স্থানেই এই হাঙ্গামার ঘটনা ঘটছে, কিন্তু তাতে নেই পুলিশি কোনো নজরদারি। পেছনের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখতে পাবো, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ঘটনার মতো কঠিন সময়ও সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রনে একযোগে কাজ করেছিল। কিন্তু মালদার ঘটনায় রাজনৈতিক সমঝোতার মৃত্যু হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ভোটের ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এর কারণটাও স্পষ্ট এবং তা হলো, কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের রাজ্যে অকার্যকর করে ফেলা।

মুর্শিদাবাদ এবং মালদাকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে সিপিআইএম এবং কংগ্রেস যে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল, তা তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র আমলে কাজ করেনি। এই দুই জেলায় বিশেষ করে পার্টিকেন্দ্রিক পরিবারগুলোর যে অন্ধ আনুগত্য ও আধিপত্য ভোটারদের প্রতি তাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে। গনি খান চৌধুরী গোত্র এবং অধীর চৌধুরী অথবা সিনহারা এই দ্বন্দ্বকে উস্কে দিচ্ছে। যদিও গনি খান এক সময় ছিলেন কংগ্রেস কর্মী, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে হেরে যাওয়ার পর তারই ছোটো ভাই আবু নাসের চৌধুরী তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জয়যুক্ত হন।

কালিয়াচক এলাকা হলো মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। কেন্দ্রিয় নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করার পর সন্দেহ করা হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ভোট পরবর্তী এক বছরে তা না হলেও, ক্রমশ তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে ধ্বংস করার জন্য ওই অঞ্চলগুলোতে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে শুরু করেছিল খুব গোপনে। যে কারণে গনি চৌধুরীরা কংগ্রেসের হয়েও যেমন কংগ্রেসের নয়, তেমনি অধীর বা সিনহারা বিজেপির হয়েও বিজেপির নয়। স্থানীয় ক্ষমতার হিসেব রাষ্ট্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কারণে তৃণমূল ও বিজেপি এখন মুখোমুখি অবস্থান করছে। যদিও বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে অবস্থান নিতে দেবে না মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু, বিজেপিকে যদি তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে না দেয়, তবে সেটা হয়ে যাবে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে রাজ্যের শোষণ। তাই এমন অবস্থায় অনেকেই মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা নস্যাত করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়েও শক্ত বিরোধী দল দরকার যারা বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষের ভেতর থেকে অবস্থান নেবে, আর সেক্ষেত্রে জনগণের প্রথম পছন্দ হতে পারে সিপিআইএম। তাই যদি হয়, তাহলে আগামী ১০১৬ সালের নির্বাচনী ফলাফল কি হতে পারে তা বলা এখনই মুশকিল।



মন্তব্য চালু নেই