পাকিস্তানি তরুণীর সঙ্গে প্রেম, ভারতীয় তরুণের নির্মম পরিণতি

প্রেম নাকি কোনো বয়স, বিভেদ, সীমান্ত মানে না। প্রেমের ক্ষেত্রে আরেকটি বহুল প্রচলিত কথা আছে, ‘প্রেমে পড়েছ তো মরেছ’। কিন্তু উত্তর ভারতের ছোট্ট শহর রামপুরের যুবক মোহাম্মদ জাবেদ কী স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন প্রেমে পড়ার কারণে তাকে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। প্রেমে পড়ার চেয়েও জাবেদের বড় অপরাধ ছিল, ভারতীয় নাগরিক হয়েও পকিস্তানি তরুণীর প্রেমে পড়া।

আর এ ‘অপরাধ’ তাকে ভারতের চোখে ভয়ঙ্কর শত্রুতে পরিণত করেছে এবং দেশটির একটি আদালত তাকে সাড়ে এগারো বছরের জেল দেয়। যদিও দুই বছর পর আদালত তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দেয়। পাকিস্তানি তরুণীর প্রেমে পড়ার অসাধারণ কাহিনী, তাদের মধ্যে বিনিময়কৃত প্রেমপত্র, তার অপহরণ এবং তারপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে নির্মম নির্যাতন, দুই বছরের দুর্বিষহ জেল জীবন এবং সবচেয়ে হৃদয়বিদারক তার প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বিস্তারিত গল্প জাবেদ বলেছেন বিবিসি-র সাংবাদিক গীতা পান্ডের কাছে।

জাবেদের বয়স এখন ৩৩। পাকিস্তানি তরুণী মোবিনার সাথে তার প্রথম দেখা হয় ১৯৯৯ সালে। মোবিনা তার দুরসম্পর্কের আত্মীয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জাবেদের অনেক আত্মীয়-স্বজন পাকিস্তানে চলে যান। জাবেদের সেসব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে স্বাক্ষাত করানোর জন্য মাকে নিয়ে করাচি যান। সেখানে প্রথম দেখাতেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যান জাবেদ-মোবিনা।

প্রেমের শুরু প্রথম স্বাক্ষাতের এক মাসের মাথায়ই দু’জন দুজনকে প্রেমের কথা জানান। সে জাদুকরী মুহূর্তটির বর্ণনা দেন জাবেদ। ‘আমরা তখন একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখানে আরও অনেক তরুণীও ছিল। কিন্তু অনেক তরুণীর ভিড়ে আমাকে দেখতে পেয়ে মোবিনা কিছুটা অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীন অনুভব করতে লাগল। সে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একটু শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, আমি যেন অন্য কোনো মেয়ের দিকে না তাকাই, কারণে সে আমাকে ভালোবাসে।

আমিও আমার ভালোবাসার কথা তাকে জানিয়ে দিলাম।’ প্রায় সাড়ে তিনমাস জাবেদ করাচিতে ছিল। এ সময়ে তাদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। জাবেদ বলছিলেন, ‘সে প্রতি সকালে কলেজের নাম করে বাড়ি থেকে বের হতো। আমি তার কলেজের গেটে তার জন্য অপেক্ষা করতাম। সেখান থেকে আমরা সিপারি পার্কে ঘুরতে যেতাম।’ জাবেদ-মোবিনার প্রেমপত্র জাবেদ পেশায় একজন টেলিভিশন মেকানিক।

ভারতে ফেরার পর তার বেতনের পুরোটাই খরচ করতে লাগলেন মোবিনার সাথে ফোনে কথা বলতে। অবশ্য মোবিনাকে জাবেদ আদর করে ‘গুডিয়া’ (পুতুল) বলে ডাকেন। তখন মোবাইল ফোন ছিল অপ্রতুল। থাকলেও সেটি সহজলভ্য ছিল না। বাধ্য হয়েই ‘গুডিয়া’র সাথে কথা বলতে হতো টেলিফোন বুথ থেকে।

সে সময় পাকিস্তানে প্রতিমিনিট টোলিফোন চার্জ ছিল ৬২ রুপি! ভারত না পাকিস্তান? এক বছর পর জাবেদ আবারও দু’মাসের জন্য করাচি যান। এরই মধ্যে উভয় পরিবারে তাদের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। যদিও কোনো পরিবারই তাতে বাধা দেয়নি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ বাসস্থান নিয়ে। মোবেনার পরিবার চায় জাবেদ বিয়ে করে করাচিতেই থেকে যাক, আর জাবেদের পরিবার চায় মোবিনাকে বিয়ে করে জাবেদ ভারতে নিয়ে আসুক।

বিষন্ন মনে জাবেদ বলছিলেন, ‘সেবারের মতো অমি যখন করাচি ছেড়ে আসছিলাম, তখন মোবিনা বলল, তুমি যাও। আমি আমার পরিবারকে বোঝাব। তারপর তুমি এসে আমাকে নিয়ে যেও। অথচ তখনও আমি ভাবতেই পারিনি যে এটাই আমাদের শেষ দেখা। আমি আর তার কাছে ফিরতে পারব না, তাকে আর দেখতে পারব না!’ এরপরের দু’বছর জাবেদের সাথে মোবিনার নিয়মিত ফোনে কথা হতো, প্রেমপত্র চালাচলিও হতো নিয়মিত। মোবিনা তাকে উর্দুতে চিঠি লিখত। কিন্তু জাবেদ আবার উর্দু জানত না। প্রেমিকার চিঠি পড়ার জন্য আস্তে আস্তে উর্দুও শিখতে শুরু করেন জাবেদ। তার ছেলের জীবনটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ জাবেদের বাবার উর্দু জানা বন্ধু মাকসুদের শরণাপন্ন হলেন জাবেদ। সে তাকে মোবিনার চিঠি পড়ে শোনাত। আর অপর বন্ধু তাজ মোহাম্মদ সে চিঠি হিন্দিতে অনুবাদ করে দিত, যাতে জাবেদ সে চিঠি বারবার পড়তে পারে।

একইভাবে মোবিনার কাছে লিখা জাবেদের হিন্দি চিঠি উর্দুতে অনুবাদ করে দিত মাকসুদ। সে চিঠি প্রিন্ট করত মুমতাজ মিয়া, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির নামের আদ্যক্ষর ‘MJ’ নানা রকম ডিজাইনে আঁকা থাকত। জাবেদ বলেন, প্রথমবারে সে ১০ পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছিল। অমি লিখেছিলাম ১২ পৃষ্ঠা। এ চিঠি লিখতে আমার ১২ দিন সময় লেগেছিল।’ অপহরণ ও নির্যাতন একদিন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। ’আমি এখনো স্পষ্টভাবে সে দিনটির কথা স্মরণ করতে পারি। এটা ছিল ২০০২ সালের ১০ আগস্ট শনিবার। আমি আমার দোকানে বসা ছিলাম।

একজন লোক এসে বললেন, তার টিভি নষ্ট হয়ে গেছে। এটি ঠিক করাতে তার বাড়ি যেতে হবে। আমি তাকে বললাম আমি বাড়িতে গিয়ে কাজ করি না। কিন্তু তাকে কিছুটা ক্ষিপ্ত ও হতবিহ্বল দেখাচ্ছিল, তাই আমি রাজি হলাম।’ এ দুজন দোকান থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হেঁটে যাওয়ার পর একটি সাদা গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গেল এবং বলা হলো তাকে অপহরণ করা হয়েছে। জাবেদ প্রথমে ভেবেছিল, অপহরণকারীরা কোনো সন্ত্রাসী বা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠি।

তারপর তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো তারা পুলিশের লোক। তার অগ্নিপরীক্ষা সেখান থেকেই শুরু। ‘তারা আমার মানিব্যাগ, ঘড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে গেল। মোবিনার দুটি চিঠি ছিল আমার কাছে। সেগুলোও তারা নিয়ে গেল। আমি উচ্চবাচ্য করলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে, এমন হুমকি দেওয়া হলো। তারা বলল- তারা আমার পরিবারকেও অপহরণ করেছে এবং অন্য একটি গাড়িতে তাদেরকেও নির্যাতন করা হচ্ছে। আমি কাঁদছিলাম এবং ক্ষমা ভিক্ষা চাইছিলাম।’

এর কিছুক্ষণ পর জাবদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়। জ্ঞান হারান তিনি। জ্ঞান ফিরে নিজেকে একটি বদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করেন এবং পরবর্তী তিন দিন তাকে এ ঘরেই নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। ‘তারা আমারে নির্মমভাবে পিটাত। আমাকে পা উপরে এবং মাথা নিচের দিকে দিয়ে একটি পানির টাবের উপর ঝুলিয়ে রাখত। একটু পরপর সে পানির মধ্যে আমার মাথা চুবাত। এটা এত যন্ত্রনাদায়ক ছিল যে আমার সহ্যের সীমা ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমি তাদেরকে অনুরোধ করলাম আমাকে যেন মেরে ফেলা হয়।’

ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র একজন এজেন্ট হিসেবে জাবেদকে অভিযুক্ত করা হলো। ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোপন খবর পাকিস্তানের কাছে পাচার করছে, এমন অভিযোগ আনা হলো তার বিরুদ্ধে। কয়েকদিন পর তাকে পুনরায় তার শহরে নিয়ে যাওয়া হলো এবং তার তিন বন্ধু মাকসুদ, তাজ ও মুমতাজকেও গ্রেফতার করা হলো। পরের দিন এ চার বন্ধুকে আদালতে তোলা হয় এবং সাংবাদিকদের সামনে ‘ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করল, আইএসের সাথে দেখা করতেই এবং গোপন খবর পাচার কারতেই জাবেদ দুবার করাচি গিয়েছিল। প্রায় দেড়মাস পর ভারতের বিতর্কিত ‘সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইনে’ তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হলো। অর্থাৎ তারা আর জামিনে মুক্ত হতে পারবেন না। কারণ আইনটি ছিল জামিন অযোগ্য। জাবেদ বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হলো অপরাধ প্রমাণিত হলে আমাদের ফাঁসি হয়ে যাবে। আমরা চার বন্ধু পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম।’

নতুন করে জীবন বাঁধছেন জাবেদ কিন্তু কেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ল জাবেদ, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না সে। জেলে থাকার সময়ে তাকে কেউ একজন বলেছিল, কারগিল যুদ্ধের পর থেকে কোনো ভারতীয় মুসলমান করাচি সফর করলেই তাকে সন্দেহের আওতায় আনা হয়। জাবেদের মতো একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে এমন আরও কয়েক ডজন যুবকের কথাও জানতে পেরেছে বিবিসি।

‘ভালোবাসাই আমাকে ‍সুখে রেখেছে’ জবেদ বলেন, ‘জেলে সবচেয়ে দুর্বিষহ সময় ছিল যখন পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতাম না। বাবার পা ভেঙে যাওয়ার পর যখন নিয়মিত আমাকে দেখতে আসতে পারত না, তখন বেশি কষ্ট লাগত। আমাকে রামপুরের জেলেই রাখা হয়েছিল। আমি সবার অনেক কাছেই ছিলাম, অথচ কত দূরে!’ জেলে থাকা অবস্থায় ভালো বন্ধুদের সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় জাবেদের। তার সেই তিন বন্ধু পুলিশের কাছে তাদের নাম বলে দেওয়ায় তাকে দোষারোপ করে। জেলের সে কঠিন আর দুর্বিষহ জীবনে নিজের প্রেমের কথা মনে করেই কিছুটা পুলকিত অনুভব করতেন জাবেদ। ‘আমি প্রয়শই আমার সাথের বন্দীদের কাছে মোবিনার গল্প করতাম। সে কি ভালোবাসত, তার অভ্যাস, তার সাথে দেখা করতে গেলে সে কীভাবে আমাকে উপহাস করত এসব গল্প আমি প্রায়ই করতাম।

এসব গল্প জেলে জীবনটা কিছুটা সহনীয় করে রাখত আর তার স্মৃতিও অমলিন থাকত। জাবেদের বাবা মায়ের জন্যও এ সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন। তার মা আফসানা বেগম সন্তানের দুর্ভাগ্যকেই দায়ী করলেন। দোষ কিছুটা নিজের উপরও চাপালেন। করাচিতে আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে না গেলেই তো আর ছেলের জীবনে এমন সর্বনাশ হতো না বলে মনে করেন তিনি। বলতে বলতে কেঁদে দেন আফসানা বেগম। জাবেদের বাবা তার সব জমি, পারিবারিক স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন।

‘আমি এখনও তাকে ভালোবাসি’ অবশেষ ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি জেলমুক্ত হন জাবেদ। ‘যখন আমি জেল থকে বের হচ্ছিলাম তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি সত্যিই জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছি। এ ঘটনা আমার জীবনের তিনভাগের একভাগ সময় শেষ করে দিল। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো আমার জীবন হারিয়ে গেল।’ গত দু’বছর ধরে জাবেদ আবার তার জীবনকে একটু একটু করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। পুনরায় একটি ছোট্ট দোকান দিয়েছেন।

কিন্তু তার ক্ষোভ হচ্ছে, তার জীবনকে যারা ধ্বংস করল, এত বড় ক্ষতি করল, তাদের কোনো সাজা হলো না বা তিনিও কোনো ক্ষতিপূরণ পেলেন না। ছাড়া পাওয়ার পর থেকে মোবিনার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়েছে কিনা, বিবিসি-র সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে জাবেন জবাব দেন, ‘না। এটা অনেক লম্বা সময়। সে হয়তো কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে।’

বিবিসি-র সাংবাদিক পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি তার সাথে যোগাযোগ করতে চান কিনা? জাবেদ জবাব দেন, ‘আমি কোনোভাবে আমার মাথা থেকে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু মন থেকে মুছতে পারছি না। আমি এখনও তাকে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে ফোন দিতে বড় ভয় হয়, না জানি আবার আমার এবং আমার পরিবারের প্রতি এরকম কিছু হয়!’



মন্তব্য চালু নেই