বাংলাদেশের পাট শিল্প ধ্বংসের জন্য বিশ্বব্যাংকই দায়ী

বিশ্বব্যাংকের নীতির অধীনে ১৯৯৪ সালে পাট শিল্পের বিকাশের জন্য সংস্থাটি থেকে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। তাদের শর্ত মানতে গিয়েই বাংলাদেশের পাট খাতকে সংকুচিত করা হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, পাটকলগুলোতে বছরের পর বছর লোকসান হয়। ফলে ভর্তুকিবাবদ প্রতিবছরই সরকারকে অর্থ বরাদ্দ দিতে হয়। এসব কারণ দেখিযে বন্ধ করে দেওয়া হয় বাংলাদেশের পাট কলগুলো।

অথচ এক সময় বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ পাটকল হিসেবে স্বীকৃত ছিল বাংলাদেশের আদমজী পাটকল। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকার ব্যবস্থা হতো পাট শিল্প থেকে। আয় হতো কোটি কোটি টাকা।

কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ভুলনীতি গ্রহণের কারণে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে এই শিল্প। তবে এর জন্য বাংলাদেশকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পা দিয়েছে। ফলে ধ্বংস হয়েছে বাংলাদেশের এই প্রধান রপ্তানি পণ্যটি।

অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে ১৯৮০ সাল থেকে ‘কাঠামোগত সমন্বয়’ নীতি বাস্তবায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। এর আওতায় কঠিন সব শর্ত মেনেই সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ নিতে হয় দরিদ্র দেশগুলোকে। এসব শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভর্তুকি কমিয়ে আনা ও সরকারের বিভিন্ন পরিসেবা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া।

পৃথিবীর অন্যতম জুট মিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা ছিল নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিল। সেখানে পাটের পণ্য উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫১ সালে। তখন প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকা আয় হতো।

অথচ বহু আলোচনা-সমালোচনার পরও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ২০০২ সালের জুনে বন্ধ করে দেয়া হয় আদমজী পাটকল। একের পর এক পাটকল বন্ধ হওয়ায় সারাদেশে কর্মহীন হয়ে পড়ে প্রায় এক লাখ শ্রমিক-কর্মচারি-কর্মকর্তা।

অথচ ওই মাসেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাট শিল্পের উন্নয়নে নানা সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যার কারণে বর্তমানে পাট শিল্পে অভাবনীয় উন্নতি করেছে ভারত।

বিশ্বব্যাংকের নীতি ও এর প্রভাব নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই ফাঁদে পা দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৪ সালে পাট শিল্পের বিকাশের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। ওই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন না হলেও, একই ধরনের ঋণ নিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাট খাত।

অথচ পাটকল বন্ধ হওয়ায় শুধু খুলনা-যশোর অঞ্চলেই প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলে জানান তিনি।

এই শিল্প ধ্বংস হওয়ার পেছনে অর্থমন্ত্রণালয়ের গাফিলতি রয়েছে উল্লেখ করে আনু মোহাম্মদ বলেন, পাট কেনার সময় হলে অর্থমন্ত্রণালয়ে টাকা থাকে না। নির্দিষ্ট সময় পরে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কিনতে হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।

১৭টি পণ্য বাজারজাতকরণে পাটের তৈরি বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। পাটকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে এবং জনগণকে পাট ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওযা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আজ ৬ মার্চ সারাদেশে প্রথমবারের মতো পালিত হয়েছে জাতীয় পাট দিবস।

এ বিষয়ে আনু মোহাম্মদ বলেন, আগের নীতিমালা বহাল রেখে পাট দিবস পালনের কোনো সার্থকতা নেই। তিনি প্রশ্ন করেন. দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সড়কে লাগানো ব্যানার-ফেস্টুন পাটের তৈরি নয়, তাহলে এ দিবস পালন করে কী লাভ?

তবে এ শিল্পের বিকাশে বন্ধ হওয়া পাট কলগুলো খুলে দেওয়া, অর্থ বরাদ্দ দেয়া, পাটের ব্যবহার ও বিশ্ব বাজারে রপ্তানি বাড়নোসহ প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করলে পাট আলোর মুখ দেখবে বলে জানান এই গবেষক।

পাট শিল্প ধ্বংসের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও দায়ী করেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মুকসুদ।

তিনি বলেন, পাট শিল্প নিয়ে অনেক চক্রান্ত হয়েছে। এটি একটি বড় ইতিহাস। অল্প কথায় এর বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলবো, শুধু বিশ্ব ব্যাংক নয়, এর জন্য আমাদের রাষ্ট্রও দায়ী।

পাট-সুতাকলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা ১০ লাখ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে আট লাখ টন। আর ভারত ও চীন রপ্তানি করে বাকি দুই লাখ টন। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি হওয়া আট লাখের মধ্যে ছয় লাখ টনই হচ্ছে সুতা। যেগুলো বিদেশে পাটজাতীয় পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। বাকি দুই লাখ টন হচ্ছে বস্তাসহ অন্যান্য পাটজাত পণ্য।

সংগঠনটির মহাসচিব শহিদুল করিম বলেন, ৭০ দশকে সিনথেটিকের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংকের ত্রুটিপূর্ণ নীতিগ্রহণের কারণে পাট শিল্প হচ্ছে। তবে সরকারি কারখানাগুলোতে লাভ না হলেও বেসরকারি কারখানাগুলো কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন-বিজেএমসির তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৬শ কোটি টাকা। অদক্ষ ও পাটের সাথে অসম্পৃক্ত লোকদের বসানোর কারণে এই প্রতিষ্ঠানে ক্ষতি হচ্ছে। অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা ও বিশ্ব বাজারে রপ্তানিসহ প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ করলে আবারও পাট শিল্প আলোর মুখ দেখবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।সূত্র : চ্যানেল আই অনলাইন।



মন্তব্য চালু নেই